বৃহস্পতিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
প্রায় দুই বছর আগে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র শাহবাগে বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা সুপার স্পেশালাইজড হাসপতালটির উদ্বোধন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অধীনে প্রতিষ্ঠিত অসাধারণ স্থাপস্থ্যশৈলীর আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত দৃষ্টিনন্দন হাসপাতালটি দূর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির প্রভাবে এতদিনেও পায়নি পূর্ণ রূপ।
তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিনের একক ক্ষমতায় নিয়োগের জন্য অপেক্ষা করছিলেন মেডিক্যাল অফিসার, কনসালট্যান্ট, সিনিয়র স্টাফনার্সসহ প্রায় ১ হাজার প্রার্থী। যাদের সবার নিয়োগ বাতিল করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় তৃতীয় দফায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন এবং সুপারিশের ভিত্তিতে পুরো নিয়োগ কার্যক্রম বাতিলের এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) বিএসএমএমইউয়ের নিয়মিত সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিন্ডিকেট সভায় উপস্থিত এক কর্মকর্তা প্ল্যাটফর্মকে জাানিয়েছেন, ‘গত ২০২৩ সালের ৩ জুলাই সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের শূন্য পদে জনবল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। সেই বিজ্ঞপ্তিতে ৫২টি পদে ৫৪৪ জনকে নিয়োগ দেওয়ার কথা জানানো হয়েছিল।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদগুলোর মধ্যে কনসালট্যান্ট পদে ৯৬ জন, মেডিক্যাল অফিসার (মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, অর্থোপেডিকস) পদে ৬০ জন, সিনিয়র স্টাফ নার্স পদে ২২৫ জনকে নিয়োগের কথা বলা হয়। এ ছাড়াও এই বিজ্ঞপ্তিতে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, অতিরিক্ত পরিচালক (অর্থ), পরিচালক (আইটি), টেকনিশিয়ান, টেকনোলজিস্টসহ সব মিলিয়ে ৫৪৪ জনকে নিয়োগের কথা বলা হয়।
এর পর ২০২৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে ৮ ক্যাটাগরির পদে ৪র্থ থেকে ৯ম গ্রেডে ১৭২ জন জনবল নিয়োগে পুনর্বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে ৬৮টি পদে জনবল নিয়োগের জন্য আবেদন আহ্বান করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে যোগ্যতা চাওয়া হয় বিএমডিসি কর্তৃক স্বীকৃত এমবিবিএস বা সমমান ডিগ্রি এবং বিএমডিসি কর্তৃক স্থায়ী রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিন্ডিকেট সভায় উপস্থিত কর্মকর্তা বলেন, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর নতুন প্রশাসন এ নিয়োগের বিষয়ে আবারও তদন্তের উদ্যোগ নেয়। পরবর্তীতে দুই দফায় তদন্ত শেষে গতকাল সিন্ডিকেট সভায় নিয়োগ প্রাপ্ত সবার নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, ‘পূর্ববর্তী তদন্ত কমিটিগুলোর প্রতিবেদন, তথ্য-প্রমাণসহ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জড়িতদের সঙ্গে কথা বলে এবং অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এত বড় অনিয়ম আর হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদন সিন্ডিকেট সভায় উপস্থাপন হলে সকল সিন্ডিকেট সদস্যও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন। তদন্তকমিটি পূর্ববর্তী রিপোর্টগুলো পর্যালোচনা করেছি। এমনকি বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আমরা, অনিয়মের সুস্পষ্ট তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করেছে।
যেখানে কল রেকর্ড ছিল, সিসিটিভি ফুটেজ ছিল, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কথোপকথনের স্ক্রিনশট ছিল, পেনড্রাইভে প্রশ্ন নেওয়া অভিযুক্ত চিকিৎসকের মিষ্টি বিতরণের ছবিসহ আরও অনেককিছু যাচাই-বাছাই করেছি। সব মিলিয়ে তদন্ত কমিটির প্রত্যেকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই সিন্ডিকেট সভায় সব নিয়োগ কার্যক্রম বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
এ ছাড়া এই বিজ্ঞপ্তিতে বিভাগীয় প্রার্থী ও বিএসএমএমইউ থেকে প্রাপ্ত পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। আবেদনের ক্ষেত্রে বয়সের সময়সীমা রাখা হয় অনূর্ধ্ব ৩২ বছর পর্যন্ত। তবে বিভাগীয় ও অভিজ্ঞ প্রার্থীর ক্ষেত্রে বয়স শিথিলযোগ্য বলেও উল্লেখ করা হয়, যার বেতন স্কেল হবে ২২,০০০-৫৩,০৬০ টাকা ( গ্রেড-৯)।
বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ৬৮ জন মেডিক্যাল অফিসার নিয়োগ দিতে সে বছরেই (২০ অক্টোবর) লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এর পর নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয় ২১ অক্টোবর রাত ৮টার পর। তবে এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য আবেদন থেকে শুরু করে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশন সবকিছুতেই বড় অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এমনকি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করেও উত্তীর্ণ হওয়ার ঘটনাও ঘটে বলে দাবি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের।
বিএসএমএমইউ প্রক্টর ডা. শেখ ফরহাদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পরিবর্তনের পর বিশ্ববিদ্যালয়টিতে যে প্রশাসন এসেছে, আমরা চেষ্টা করছি ভালো কিছু করার। ইতিমধ্যে আমরা বিগত সময়ের সকল দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছি, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রদের ওপর হামলার ঘটনায় তদন্ত করে মামলা করেছি।’
এ ছাড়া নিয়োগ বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি, টেন্ডারবাজি, এগুলো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসন বেশ কিছু তদন্ত কমিটি করেছে। এমনকি সেগুলোর তদন্ত রিপোর্ট একের পর এক আমাদের হাতে আসতে শুরু করেছে। এসবের ওপর নির্ভর করে আমাদের পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে।
এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন বিএসএমএমইউ বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শাহিনুল আলমও। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘বুধবার আমাদের নিয়মিত সিন্ডিকেট সভা ছিল। সভায় বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগের সময়ে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।’
তিনি আরো জানান, ‘গত ১৫ বছরে চিকিৎসক-কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন বৈষম্যের বিষয়ও এসেছে। সে অনুযায়ী সিন্ডিকেট সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা-পর্যালোচনা করে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, শিক্ষা-চিকিৎসায় বিশ্ববিদ্যালয়টির হারানো গৌরব আবারও ফিরিয়ে আনতে পারবো।’
নিয়োগ কার্যক্রম বাতিল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, ‘ড. শারফুদ্দিনের সময়ে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে নিয়োগ বাণিজ্য এবং পরীক্ষায় অনিয়মের যে অভিযোগ উঠেছিল, সেগুলো নিয়ে পরবর্তী ভিসির (দীন মো. নূরুল হক) সময়েই দুটি তদন্ত কমিটি হয়েছিল। প্রথম তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও দ্বিতীয় তদন্তে অস্পষ্টতা আছে বলে জানানো হয়। তাই আমর এসেই নতুন করে আবারও তদন্ত কমিটি গঠন করি। সেই তদন্ত কমিটি যাচাই-বাছাই শেষে আজ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছে এবং আমরা তাদের সুপারিশ অনুযায়ী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
প্ল্যাটফর্ম/এমইউএএস