১২ মার্চ ২০২০: [কোভিড-১৯ নিয়ে ক্রমবর্ধমান আতংক এবং বিমানবন্দরে এর শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে লিখেছেন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, ঢাকা এর সহকারী বিমান বন্দর স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আবীর শাকরান মাহমুদ।]
করোনা নিয়ে সাধারণ জনগণ অনেক ভীতসন্ত্রস্ত। আসলে তাদের দোষ দিচ্ছিনা। মানুষ যে জিনিসটা স্বভাবতই কম জানে, তা নিয়ে খুব ভীতসন্ত্রস্ত থাকে। কেননা, মানুষ রহস্যকে ভয় পায়। করোনা এখন আমাদের কাছে রহস্যময়। মায়া লাগছে যে, ডাক্তার সমাজেও এ ঘটনা নিয়ে উদ্বেগের শেষ নেই। জেলা-উপজেলা সরকারি-বেসরকারি সব লেভেলের চিকিৎসক নিজেদের সেইফটি নিয়ে খুবই চিন্তিত। অবশ্য, সেটাও স্বাভাবিক। চীনে-যুক্তরাষ্ট্রে কয়েকজন হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন। কয়েকজন ইতোমধ্যে মারাও গিয়েছেন। মায়া হচ্ছে তাঁদের জন্য।
আমি এয়ারপোর্টে কাজ করছি মাসখানেক হল। নিজেদের সেইফটির কথা প্রথম কয়েকদিন চিন্তা করেছিলাম। এরপর মাথা থেকে বাদ দিলাম। কেননা, আমাদের সরকার চেষ্টা করছে, কিন্তু একথা সত্য হলেও বুঝতে পেরেছিলাম সরকারের সীমাবদ্ধতা আছে। সব দেশের সরকারই এ ঘটনাকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। আমাদেরই বা ব্যতিক্রম হবে কেন? এজন্য, সরকারকে দোষ দেয়া ছেড়ে দিয়েছি। আর কাকেই বা দোষ দিব? আমি-আপনারা-আমরা সবাই মিলে তো সরকার। এজন্যই তো প্রতিনিয়ত সরকারের হয়ে জনগণের গালি খাচ্ছি। বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে যে কোন ভাইরাস সনাক্ত করা যায় না, আর শুধুমাত্র জ্বর হলে তাপমাত্রা বেশি থাকলে সেটি শনাক্ত করা যায়- সকলকে এটি বুঝাতে বুঝাতে আমি ক্লান্ত। ‘যেটা জানার ছিল না, সেটা অজানাই থাক। সব জানলে নষ্ট জীবন।’ কোন জ্বর, সর্দি, কাশি বা উপসর্গ না থাকলে কোন ব্যক্তির দেহে যদি ভাইরাস সুপ্ত অবস্থায় থাকে, সেটি ডিটেকশন বিমানবন্দরে করা সম্ভব না। এটাই স্বাভাবিক। কেবল আমাদের বিমানবন্দরে কেন, সেটি কোন দেশের বিমানবন্দরেই সম্ভব না। এর থেকে বেশি ইন্টেন্সিভ টেস্ট বা পিসিআর সবার সেইফটির কথা চিন্তা করেই বিমানবন্দরে করা যায়না। কেননা, ল্যাব টেস্ট করতে গেলে যদি আউটব্রেক হয়, সেকেন্ডের মধ্যেই বিমানবন্দরে সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর বিমানবন্দরে ছড়ালে যারা আগত যাত্রী তাদের মাঝে ছড়াতে কতক্ষণ? পুরো দেশেই তখন ছড়িয়ে যাবে দিনের ভিতর। ইনফেকশন কন্টেইন করা অসম্ভব হয়ে যাবে।
আর এজন্যই এভাবে বাহির থেকে করোনা’র অন্যপ্রবেশ রুখে দেয়া যায়না। আর যায় না বলেই যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশ এত স্ট্রং সিকিউরিটি সিস্টেম দিয়েও নিজেদের ভেতরে করোনা’র অনুপ্রবেশে বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। আমরাও যেমন পারিনি। এজন্য আসলে বিমানবন্দরে স্ক্যানিং প্রক্রিয়াকে দুর্বল বলে দায়ী করে লাভ নেই। ট্রাস্ট মি, আমরা চেষ্টা করছি, যে কয়জন ডাক্তার, নার্স, স্যানিটারি ইন্সপেক্টর আছি। একটানা থার্মাল স্ক্যানার পর্যবেক্ষণ করছি। থার্মাল স্ক্যানার নষ্ট হলে হ্যান্ড হেল্ড স্ক্যানার দিয়ে চেক করছি একে একে। পালাক্রমে আমরা ২৪/৭ ডিউটি করছি। রাত নেই, দিন নেই, না ঘুমিয়ে, না খেয়ে, পানি না খেয়ে, টয়লেট চেপে। কিন্তু কী আর করা? গালি খেতে হবে, খাচ্ছি। আমাদের কথা কে ভাবে? আমরা মানুষ না, আমরা তো ডাক্তার।
মানুষের সীমাবদ্ধতা থাকে, কিন্তু, ডাক্তারদের তো তা থাকে না।
পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) এর দুষ্প্রাপ্যতা আগে থেকেই। সেটা শুধু সাধারণ বাজারে না, সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সরকার চেষ্টা করে দৈনিক সরবরাহ দিয়েও কুলাতে পারছে না। টিস্যু চাইলে পাওয়া যায়না, হ্যান্ড স্যানিটাইজারও। হাতের এক গ্লাভস চালাচ্ছি সারা দিন যাবত। n95 মাস্ক তো দূরের কথা, এক সার্জিক্যাল মাস্ক চালাই দিনের পর দিন। এদিকে সব গুদামজাত করে রাখে সাচ্চা হালাল ব্যবসায়ীরা। আমি ডাক্তার হয়েও ফার্মেসিতে খুঁজে কিছু পাইনা। আগেই বহু প্যানিকড মানুষজন সব কিনে শো-কেসে সাজিয়ে রাখছে। কষ্টের ব্যাপার হল, বুঝতে পারি নিজেদের ব্যাপারে সেইফটি মেজার নিয়ে আমাদের আসলে খুব একটা লাভ নেই। সারাদিন যেহেতু এক্সপোজার হচ্ছেই, শরীরে তো অলরেডি ঢুকে যাওয়ার কথা। এন্ট্রি যেহেতু বিমানবন্দর দিয়েই বেশি হয়, ধরেই নিয়েছি আমাদের শরীরে পিসিআর করলে এখন করোনা সুপ্ত পাওয়া যাবে। যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের কথা ভাবার সময় কার? আজ দায়িত্ব পালনকালে এক বিদেশফেরত ভদ্রলোক হেলথ ফর্ম ফেরত দেয়ার সময় জিহবার থুতু দিয়ে ভিজিয়ে পাতা উল্টিয়ে দিলেন। আরেকজন আমার কলম ধার নিয়ে দাঁত দিয়ে কলমের ঢাকনা খুললেন। আরেক ব্যক্তি ওয়াক করে কফ ফেললেন আমার ডেস্কের পাশে কাগজ ফেলার ওয়েস্ট পেপার বিনে। আমি দেখলাম, আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলাম। জানি, বলে লাভ নেই। এ জাতি খালি ডাক্তারদের দোষ ধরে বেড়াবে, কিন্তু হাত ধোয়া, যেখানে সেখানে কফ থুতু ফেলা, হাত দিয়ে নাক মুখ খোঁচানো- এসব চিরন্তন অভ্যাস পরিত্যাগ করতে পারবে না। সবাই খালি সরকারের দোষ খুঁজে বেড়াবে, অথচ আমরা নিজেরা যে দিনের পর দিন এই মৃত্যুকূপে কাজ করে যাচ্ছি, একজন মানুষকে অথবা কর্পোরেট লেভেলের ফার্মকে এগিয়ে আসতে দেখলাম না। বিদেশে শুনছি, প্রাইভেট সেক্টর সরকারকে জিনিসপত্র দিয়ে সহায়তা করছে। সবাই বাসার ভিতর রুমে বসে অনেক বিপদের ভয়ে আছে, এদিকে কোন সাংবাদিক বা অন্য সেক্টরের কেউ এসে আমাদের কী লাগবে না লাগবে একবার জিজ্ঞাসাও করল না। অথচ পাড়ার অলিতে গলিতে চেম্বারে স্যাম্পল দিয়ে ঔষধ কোম্পানিগুলো ভরিয়ে ফেলে। সরকারের সমালোচনা করার মানুষের অভাব নেই, অথচ কোন ভলান্টিয়ার পাওয়া যায়না। আউটব্রেকের আগে থেকেই এদিকে গ্রামে-গঞ্জে নিজেদের সেইফটি নিয়ে গ্রুপে পোস্টের অভাব নেই। সবাই কত কনসার্ন! আমাদের খবর কে রাখে?
“কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল যে, সে মরে নাই।” আমরা ডাক্তারেরা হয়তোবা মরে প্রমাণ করব, আমাদেরও করোনা হতে পারে।
না, ভুল ভাববেন না। নিজের জন্য ভয় লাগে না। তবে ভয় লাগে পরিবারের জন্য, বাবা মার জন্য। বয়স্ক মানুষ যারা ডায়াবেটিস, ক্যান্সারের রোগী-তারা যে করোনা’র প্রধান শিকার তা কারো অজানা না। এদিকে আমার মা দুর্ভাগ্যক্রমে আবার টার্মিনাল স্টেজ থ্রি ক্যান্সারের রোগী। এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় ফিরে আব্বা আম্মাকে তাই বলি, আমি বাসায় ফিরলে আমার থেকে যতটা পারা যায় দূরে থাকবা। বাসায় যতক্ষণ থাকি, রুমের ভিতর থাকি। বাসা টু এয়ারপোর্ট, এয়ারপোর্ট টু বাসা। কয়েক সপ্তাহ ধরে বন্ধু-বান্ধবের সাথে মেলামেশা কমিয়ে দিয়েছি বাইরে। বাজারে, মসজিদে, পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন কোর্সের ভার্সিটিতে যাওয়াও কমিয়ে দিয়েছি পাবলিক প্লেস দেখে। কিন্তু, বাবা মাকে কিভাবে দূরে রাখতে পারি??
তাঁদের জন্যই ভয় লাগে। নিজের জীবন গেলে যাবে। আজ হোক, কাল হোক, যেতে তো হবেই। নিজের জন্য আমি কখনই ভয় পাইনা।
ভয় কেনই বা থাকবে? আমাদের নিয়ে মানুষ কেনই বা ভাববে?
আমরা কি মানুষ?
আমরা ডাক্তার।
মানুষের জীবনের ভয় থাকে।
ডাক্তারদের ভয় থাকে না।
ডাক্তারদের ভয় থাকতে নেই।