প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৩ জুলাই ২০২০, শুক্রবার
লে• কর্নেল ডা. উম্মে রুমান
এফ সি পি এস
স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞ
আমরা এখন করোনা মহামারীর শিকার আর সাক্ষী।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে:
১. খ্রীষ্ট পূর্ব ৩০০০ বছর আগে চীনে একটা মহামারিতে সব বয়সের প্রচুর মানুষ মারা যায়। এটা ‘সারকা’ (Circa) নামে পরিচিত। যার কারণ জানা যায় নাই। কংকাল পাওয়া যায়। মানুষ বাসার ভিতর মারা যায় আর তাদের পরে পুড়িয়ে দেওয়া হত। উত্তরপূর্ব চীনের এই জায়গা ‘হামিন- মাংঘা’ নামে পরিচিত।
২. খ্রীষ্ট পূর্ব ৪৩০ বছর আগে এথেন্সে হয় প্লেগ মহামারি। এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে যুদ্ধ লাগার পর। ইতিহাসবিদদের মতে একদম সুস্থ মানুষ হঠাৎ তীব্র মাথা ব্যথা, চোখ আর মুখের ভেতর লাল হয় যেত। কেউ কেউ এটাকে টাইফয়েড বা ইবোলা বলে। ৫ বছর ছিল। ১০,০০০০০ লাখ মানুষ মারা যায়। আজব মানুষ কিন্তু যুদ্ধ থামায় নি। এথেন্স পরাজিত হয়৷
৩. এনটোনাইন প্লেগ: খ্রীষ্টাব্দের ১৬৫-১৮০। রোমান সেনারা গুটি বসন্ত সাথে করে নিয়ে আসে শিবিরে। পাঁচ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। এটা এক জায়গায় প্লেগ এক জায়গায় গুটি বসন্ত লেখা।
৪. সাইপ্রিয়ান প্লেগ (খ্রিষ্টাব্দের ২৫০-২৭১): ইউরোপের এই প্লেগ প্রতিদিন পাঁচ হাজার করে মানুষ মরেছে শুধু রোমেই। তখনকার বিশপেরা এটাকে পৃথিবীর শেষ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্ত পৃথিবী টিকে যায়। পুরাতত্ত্ব বিদেরা ফসিলের গায়ে লাইমের স্তর পেয়েছিলেন, যা ডিসিনফ্যাক্ট্যান্ট হিসাবে ব্যবহার হতো। বাকিদের পুড়িয়ে মারা হত।
৫. জাস্টিনিয়ান প্লেগ (খ্রীষ্টের ৫৪১-৫৪২): বুবোনিক প্লেগে পৃথিবীর ১০% মানুষ মারা যায়।
৬. ব্ল্যাক ডেথ (১৩৪৬-১৩৫৩): এটা ভয়ংকর ছিল। আবারো প্লেগ। ইউরোপের অর্ধেক মানুষ নাই হয়ে গিয়েছিল। এতে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় টেকনোলজীর উন্নয়ন ঘটে।
৭. আমেরিকান প্লেগ: ১৬শ শতাব্দিতে ইউরোপীয় অভিজান কারীরা সাথে করে গুটি বসন্ত নিয়ে যায় আমেরিকায়। ৯০% আমেরিকান আদিবাসিদের মৃত্যু হয়৷ আযটেক আর ইনকা সভ্যতা কিছুটা ধংস হয়৷
৮. গ্রেট প্লেগ অফ লন্ডন (১৬৬৫-১৬৬৬): ব্ল্যাক ডেথ এর শেষ ছোবল। ১০০০০০ মানুষ প্লেগে মারা যায়।
৯. গ্রেট প্লেগ অফ মারসেইল (১৭২০-১৭২৩): কোয়ারেন্টাইন এ থাকা এক জাহাজ গ্র্যান্ড সেইন্ট এন্টইন থেকে প্লেগ ছড়ায়। জীবাণু মারা যায় নাই। মাছি জাহাজ থেকে ইঁদুর আক্রান্ত করে। তা জনপদে ছড়িয়ে যায়। আবারো ১০,০০০০ মৃত্যু ৩ বছরের মধ্যে।
১০. রাশিয়ান প্লেগ ( ১৭৭০-১৭৭২): প্লেগের জন্য কোয়ারান্টাইনে থাকা নাগরিকদের আতংক ক্রোধে রুপ নেয়। রায়ট শুরু হয়। প্লেগের বিস্তার ঘটে। ১০,০০,০০০ মানুষ মারা যায়। রানি দ্বিতীয় ক্যাথেরিন সব কারখানা মস্কো সরিয়ে নিয়ে যান। প্লেগ শেষ হওয়ার পরেও এই মহিয়সী সম্রাজ্ঞী প্লেগ নির্মূলের চেষ্টা ছাড়েন নি।
১১. ফ্লু প্যান্ডেমিক (১৮৮০-১৮৯০): যানবাহনের উন্নয়নের ফলে পুরা পৃথিবীজুড়ে মাত্র কয়েক মাসে ফ্লু ছড়িয়ে পড়ে। ১ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়।
১২. স্প্যানিশ ফ্লু ( ১৯১৮-১৯২০): দক্ষিণ মহাসাগর থেকে উত্তর মেরু পর্যন্ত বিস্তৃতি পাওয়া ফ্লুতে ৫০০ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। কিছু ছোট জাতি হয় লুপ্তপ্রায়। এর প্রকোপ বৃদ্ধি পায় সইনিকদের দুর্বল শরীর আর পুষ্টিহীনতায়। স্পেনে এটার জন্ম নয়। স্পেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকায় তাদের প্রেস স্বাধীনতা ছিল। তারাই খবর ছাপাত।
১৩. এভিয়ান ফ্লু (১৯৫৭-১৯৫৮): চীনে জন্ম নিয়ে এই এভিয়ান ফ্লু ভাইরাস খুব দ্রুত ১.১ মিলিয়ন প্রাণহানি ঘটায়।
১৪. সোওয়াইন ফ্লু প্যান্ডেমিক (২০০৯-২০১০): সিডিসির মতে ১.৪ বিলিয়ন আক্রান্ত হয়৷ দেড় লাখ থেকে ছয় লাখ আনুমানিক মৃত্যু। এখন ভ্যাক্সিন চলে আসছে।
১৫. কোভিড ১৯: জানি না কখন শেষ হবে। এতো কিছু কেন লিখলাম? আমরা তো আসি আর যাই। যত অত্যাচার সয়ে যায় এই পৃথিবী। মহামারী তার সময়মত আসবে আবার চলেও যাবে। কিছু প্রাণ নিয়ে যাবে। আমরা কাঁদবো। আবার ঘুরে দাঁড়াবো। আবার ফুল ফুটবে। আকাশ হবে নীল। পৃথিবীই তার নিজ নিয়মে সব ঠিক করে নেবে।
যদি মারা যাই, শহীদ হবো। যদি বেঁচে থাকি, তাহলে ইতিহাসের সাক্ষী হবো। বলতে পারব,
“হ্যা, মহামারি আমরাও দেখেছি। দেখেছি মানুষের চোখে ভয় আর অগনিত মৃত্যু। মানুষ গুলার গায়ে হাত দিয়েছি নির্ভীকভাবে, চিকিৎসা করেছি। আর আমরা সম্মুখ যোদ্ধা ছিলাম।”