প্রথমে ছিল মন্দির, এরপর কখনো বৃদ্ধ অনাথ শিশুদের আশ্রম, কখনো ক্লান্ত পথিকের দাতব্য পান্থশালা । লোকালয় থেকে দূরে পাহাড়ে অচ্ছুৎদের বাসস্থান হয়েছে, আবার লাইব্রেরি-গুরু শিক্ষার্থীদের তীর্থ হিসেবেও সমাদৃত হয়েছে মধ্যযুগে । চার্চ যেমন এর দখল নিয়েছে, সাম্রাজ্যবাদীরা দেশ দখলের কৌশল হিসেবে একে ছড়িয়ে দিয়েছে। ইতিহাসের নায়ক শাসকেরা জনকল্যাণে স্থাপন করেছে, একেকটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে শাসকদের ক্ষমতায় যাবার ঘুঁটি যোদ্ধাদের প্রাণ বাঁচিয়েছে। অসভ্য বর্বর জনপদে ক্ষুধা-রোগ-অশিক্ষা দূর করতে এর ছদ্মবেশে মিশনারিরা ধর্ম প্রচার করেছে। একেকটা মহাযুদ্ধ এটির জন্য ছিল টাইম মেশিন, একেকটি বিশ্বযুদ্ধ বদলে দিয়েছে এর খোলনলচে । জন্মান্ধ, রাজপুত্র, বৃদ্ধ, নবজাতক, বিশ্বজয়ী বীর, বিধবা গৃহবধূ, মুচি, শিক্ষক, দালাল, বিচারক-কাউকে ফিরিয়ে দেয় নি, কারো জন্য এর দুয়ার বন্ধ থাকে নি। পৃথিবীর কোন উপসনালয় বা দ্বিতীয় কোন জায়গা মানুষের মন কিংবা শরীরে যন্ত্রণা উপশম করতে পারেনি, এখানে নিতান্ত সংশয়ী অবিশ্বাসীও আত্মসমর্পণ করে সৃষ্টিকর্তার কাছে । হাসপাতাল এমন একটা জায়গা যেখানে মানুষ আল্লাহকে ডাকে ব্যকুল হয়ে। রোগ-জরা-মৃত্যু ভয় ছাড়াও একবিংশ শতাব্দীর এই বাংলাদেশে হাসপাতালের এক বিভীষিকাময় সংস্করণ প্রাইভেট ক্লিনিকে মানুষ আল্লাহকে ডাকে সম্পূর্ণ চিকিৎসা বহির্ভূত কারণে । আজ ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে লিখছি প্রাইভেট ক্লিনিক নিয়ে।
ইতিহাসের গল্প ফেঁদেছিই যেহেতু আমেরিকার প্রথম হাসপাতাল পেনসিলভেনিয়া হাসপাতালের জন্মকথা দিয়ে ভূমিকা শেষ করছি। সময়টা আমেরিকার শিল্প বিপ্লবের। আমেরিকার ব্যস্ততম উন্নয়নশীল শহরগুলোর একটি তখন ফিলাডেলফিয়া, দশ বছরের মাথায় শহরের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছিল। রাস্তার পাশে পরে থাকা অসুস্থ নিঃস্ব ব্যক্তি এবং মানসিক ভারসাম্যহীনদের জন্য এগিয়ে এলেন শহরের বিশিষ্ট নাগরিকেরা। তখনকার নাগরিকেরা নিজেদের অর্থে, সরকারি সাহায্যে এই দরিদ্র মানুষগুলোর জন্য প্রতিষ্ঠা করলেন একটি হাসপাতাল। হাসপাতালের দেয়ালে অন্যতম উদ্যোক্তা বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন লিখে রাখলেন-“ This Building…Was piously founded,
For the Relief of the Sick and Miserable”। উপজেলায় চাকরি করি আট মাস হতে চলল, তার আগে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ নামস্বর্বস্ব বৃহৎ ক্লিনিকে চাকরির সুবাদে, ইন্টার্নশিপের সময় দু’দিনের খ্যাপ এবং ঢাকায় বিভিন্ন পরিচিতজনদের মাধ্যমে বিভিন্ন বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রের অভিজ্ঞতা থেকে লিখছি। ক্লিনিক-ডায়াগন্সটিক সেন্টারগুলো রূপকথার সেই ডাইনী বুড়ির মত ১৪ বছরের রাজপুত্র দেখলে যার লকলকে জিহ্বা বের হয়ে লালা ঝরে। ধনী-মধ্যবিত্ত-হতদরিদ্র রোগী যেই হোক না কেন ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ম্যানেজমেন্টের মুখ দিয়ে লালা ঝরে লোভে। আমেরিকার সাদা চামড়ার প্রতি কোন ভক্তি আমার নেই কিন্তু বাংলাদেশের ১৯৮২ সালের এ সংশ্লিষ্ট আইনেই আছে প্রতিটা বেসরকারি হাসপাতাল/ক্লিনিকে মোট শয্যার ১০% হারে বিনা খরচের শয্যা থাকতে হবে।
বালতি মেথডঃ দেশের আনাচে কানাচে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেটের সামনে, সদর হাসপাতালের রাস্তার ওপারে, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পেছনের চিপা গলিতে, যে অঞ্চলের মানুষ বেশি বিদেশ থাকে নোয়াখালী, ফেনী, চৌদ্দগ্রাম, মৌলভীবাজার বা হবিগঞ্জে সব চেয়ে সহজ অথচ নির্ভুল যে উপায়ে আপনার রক্ত, প্রস্রাব আরো যা কিছু পরীক্ষা করা হয় তার নাম বালতি মেথড। আপনার শরীরে নমুনা এক হাতে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ঢুকাবে আরেক হাতে টেবিলের পাশে ময়লার বালতিতে সংগৃহীত নমুনা ফেলে দিবে। নমুনা নেবার সময় আপনার সাথে কয়েক সেকেন্ড কথা বলবে-আপনি যদি মহিলা হন প্রস্রাবে ইনফেকশন থাকবে, গায়ে জ্বর থাকলে টাইফয়েডের জীবাণু পাঁচ মিনিটেই আবিষ্কার করে ফেলবে, আপনার একটু দূর্বলতা থাকলে হিমোগ্লোবিন সাত আটের নিচে নামায় দিবে-আপনারাও খুশি এত দামি টেস্ট দিল, রক্তে যদি কিছু নাই বা পাওয়া যায় তাইলে টাকাটাতো জলে গেল। দোষ কার ডাক্তারের? আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যাদের হাতে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য কোন আইনই নাই? না স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের? না মুনাফালোভী ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকদের? আচ্ছা এই ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কতগুলোর মালিক বা ম্যানেজমেন্টে ডাক্তার আছে জানেন? বালতি মেথড একটা উদাহরণ মাত্র-এরকম হাজারো উদাহরণ দেয়া যেত আপাতত একটিতেই থামছি।
স্বাস্থ্য ব্যবসায় (ডায়াগনস্টিক সেন্টার/ক্লিনিক) লাভ ৩০০%। দেশে এই মুহুর্তে প্রায় ৮২০০টি নিবন্ধিত স্বাস্থ্য ব্যবসা আছে, বাকি প্রায় দেড় লক্ষ প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেই কাজ করছে। এবং স্বনামধন্য চিকিৎসকেরা চেম্বার করেন এমন হাতে গোণা ক্লিনিক/ডায়াগন্সটিক সেন্টার ছাড়া বাকি ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কাস্টমার/রোগী পাবার উৎস হচ্ছে দালাল। পেরিফেরিতে স্ট্রাগলিং নবীন ডাক্তারের চেম্বারে রোগীর ২০০টাকা ভিজিটের ৫০ টাকা দালাল পায়, অনেক কন্সাল্টেন্টের চেম্বারের ৫০০টাকা ভিজিটের ২০০টাকা ক্লিনিক/ড্যাগনিস্টিক সেন্টারের ম্যানেজমেন্ট রেখে দেয়। লেখার এ পর্যন্ত পড়ে অনেকের কাছে হয়ত আমার ব্যক্তিগত ক্ষোভ পরিষ্কার হয়ে যাবে কিন্তু আমার ক্ষোভ দালাল বা প্রাইভেট ক্লিনিক/ডায়াগন্সটিকের উপর নয়। দুদিন আগে আইসিডিডিআর,বির একটু গবেষণা কার্যক্রমে পর্যবেক্ষক হিসেবে গিয়ে জানতে পারলাম দেশে প্রতি ২৯টি নবজাতক শিশুর জন্মের ১৭টি হয় বেসরকারি ক্লিনিক বা হাসপাতালে।
এই একটা সংখ্যা আপনাকে কাঁপিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। একবার চিন্তা করুনতো এই ক্লিনিকগুলোর মালিকানা মুনাফালোভি রিকশার গ্যারেজের মালিক, মাছ বিক্রেতা, ঝুঁট কাপড়ের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে আর কি কি পেশার হতে পারে। এগুলোতে গাইনীর কন্সাল্টেন্ট আছেন-নাই! এনেস্থেটিশিয়ান আছেন-নাই! পেডিয়াট্রিশিয়ান আছেন-নাই! এখানে কি শুধু সিজারই হয়-লেবার রুম আছে-নর্মাল ডেলিভারি হয়-না! প্রশিক্ষিত নার্স আছে-না! ২৪ ঘন্টা ডাক্তার আছে-সিজারের পর ফলোআপ রোগীর দেখাশোনা করবে এমন ডিউটি ডাক্তার-না! কোন ইমার্জেন্সি হলে কমপ্লিকেশন হলে রেফারাল-না-ডিশোল্ডারিং-রোগিকে ভাগিয়ে দেয়া হয়! সরকারি হাসপাতালের মত না, বাথরুমে পানি আছে, অক্সিজেনের সিলিন্ডার আছে, পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ড না থাকুক এসি কেবিন আছে। কয়টা রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে রেজিস্টার খাতা আছে-নাই! কি কি পরীক্ষা হয় সেটার মূল্য তালিকা আছে-নাই! কিন্তু একটা খুব ক্যারিশমাটিক ম্যানেজার আছে-ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্ট আছে-রোগীর থেকে কিভাবে টাকা আদায় করতে হয় তা জানা আছে। ঢাকা কিংবা বড় শহরে নতুন ব্যবসা হচ্ছে আইসিইউ-এনআইসিইউ ব্যবসা। রোগীর ডায়রিয়া হোক কিংবা পালপিটিশন আইসিইউ আছে না, ডায়ালাইসিস মেশিন আর আইসিইউ সাপোর্টসহ ক্লিনিক-বাংলাদেশে টাকা থাকলে আজরাইলের সাধ্য কি আপনার জান কবজ করার!
স্বাস্থ্য বিভাগের অনুমোদন আছে? হালনাগাদ করা আছে? পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র আছে?(অপারেশনের পর রক্ত-তরল বর্জ্য কোথায় ফেলে? বিষাক্ত জীবাণযুক্ত বর্জ্য আপনার বাসার সামনের ডাস্টবিনে ফেলছে না তো)? পরমাণু শক্তি কমিশনের ছাত্রপত্র আছে তো?(এক্সরে যেখানে হয় তার দেয়াল একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পুরু এবং বিভিন্ন প্রটেকশন ব্যবহার করতে হয়, না হলে বিকিরণ ছড়িয়ে পড়বে-একই রকম বিকিরণ জাপানে এটম বোমা ফেলার হাজার হাজার মানুষের ক্যান্সার করেছে, আপনার বাসার পাশেই নেইতো এমন কোন সেন্টার)। অথবা ম্যানেজমেন্ট হয়ত জানেই না কি কি থাকা দরকার, করা দরকার। জানানোর দায়িত্ব কার? দেখাশোনার দায়িত্ব কার?
তবুও বাংলাদেশের মানুষ এদের কাছে যায়। কেন যায়-একটাই কারণ বেসরকারি যে কোন খাতে সব কিছু দ্রুত হয়, হয়রানী কম। হ্যাঁ এরা হয়ত দ্রুত কাটবে, কিন্তু কে কাটবে-কী কাটবে-কেন কাটবে আপনি কোন দিন বুঝতেও পারবেন না। আমরা চাইলেই এক দিনে এসব কিছু বন্ধ করতে পারবো না, এদের অবদান অস্বীকারও করতে পারবো না তবে আমরা একটু সচেতন হতে পারি। সচেতনতার জন্যেই এ লেখা-কাউকে দোষ দিতে নয়। বাংলাদেশটা আমাদের সবার, চাইলেই লাথি দিয়ে নষ্ট লোকগুলো বের করে দিতে পারবো না সিস্টেম থেকে তবে নিষ্ক্রিয় থেকে আর্থিক-শারীরিক-মানসিক সর্বনাশের আগে আসুন চ্যালেঞ্জ করি অথরিটিকে। একজন চিকিৎসক হিসেবে চিকিৎসকদের পক্ষ নিয়েই লিখছি-কারণ চিকিৎসকেরা যতক্ষণ বিদ্রোহী হয়ে এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে একা কিছু বলতে যায় তাঁদের অস্তিত্ব হুমকীতে পড়ে কিন্তু সাধারণ মানুষ ঢালাওভাবে চিকিৎসকদের দোষারোপ না করে কর্তৃপক্ষকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করলে সব নষ্টামিগুলো বন্ধ হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের স্লোগান বছর বছর পরিবর্তন হবে কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের জিম্মি দশার মুক্তি ঘটবে না যদি আমরা সাধারণ মানুষ সচেতন না হই।
ডাঃ মোহিব নীরব
এ সম্পর্কিত আইনটি
http://bdlaws.minlaw.gov.bd/pdf/620___.pdf
সারা বাংলাদেশে ২৩টি উপজেলায় ২০শ্য্যা বিশিষ্ট সরকারি হাসপাতাল আছে যেগুলোর কোনো স্থাপনা নাই কিন্তু ডাক্তার পোষ্টিং দেওয়া আছে,এসব হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক এবং অন্যান্য দের বেতন বছরে একবার হয় কারণ হিসেবে বলা হয় হাসপাতালের স্থাপনা নাই,আর ডাক্তাররা কেউ কেউ সদর হাসপাতালে বেগার খাটছে কোন বেতন ছাড়া।আমাদের কথা হল স্থাপনা না থাকলে কেন নিয়োগ দেয়া হয় আর বেতন কেন বছরে একবার হবে??সব ডাক্তার ত কনসালটেন্ট না যে বেতন না হলেও চলবে মেডিকেল অফিসাররা মানবেতর জীবন যাপন করছে।এগুলো দেখার কি কেউ নাই?
এটাই বাস্তবিক বাংলাদেশ।এটাই আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা।