বিশ্ব হার্ট দিবস: জর্দার গৌরব ও সিগারেটের সম্মান

হৃদরোগ এখন সারা বিশ্বের এক নম্বর মরণব্যাধি। অন্যান্য রোগের তুলনায় হঠাৎ মৃত্যুর সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি হৃদরোগে। বিনামেঘে বজ্রপাতের মত মুহূর্তে সবকিছু তছনছ হয়ে যেতে পারে। একটি মানুষের মৃত্যু শুধু নয়, গোটা পরিবারটির উপর নেমে আসে বিপর্যয়ের গভীর অমানিশা। বিশেষ করে মানুষটি যদি হয় পরিবারের আয়ের প্রধান ব্যক্তি। তাই আমাদের হাতে সময় থাকতে সচেতন হওয়া দরকার কীভাবে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

প্রায় প্রতিটি রোগের চিকিৎসার দুটো ধাপ থাকে। একটি হল রোগ প্রতিরোধ, যাতে রোগটি শরীরে বাসা বাঁধতে না পারে। আর দ্বিতীয়টি হল প্রতিকার, রোগটি দিয়ে আক্রান্ত হলে তা থেকে মুক্তির চেষ্টা। বলা বাহুল্য যে, রোগ প্রতিরোধই উত্তম। শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিক- সবদিক থেকেই মঙ্গলজনক ।

১। প্রথমে আসি শারীরিক ব্যাপারে। ধরা যাক রাজধানী থেকে দূরে কারো হার্ট এ্যাটাক হল। প্রাথমিক চিকিৎসা এখন মোটামুটি সব জায়গাতেই আছে। সেটা না হয় দেয়া গেল। কিন্তু উন্নত আধুনিক চিকিৎসা তো রাজধানীসহ সামান্য কিছু কেন্দ্রে বিদ্যমান। তাই হার্ট এ্যাটাকে আক্রান্ত ব্যক্তিটি রাজধানীতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে স্বাভাবিকভাবেই বিলম্ব করবে। তাতে কী সমস্যা হবে? হার্ট এ্যাটাকে যত মৃত্যু হয় তার শতকরা ২৫ ভাগই ঘটে হাসপাতালে পৌঁছানোর পূর্বে। সুতরাং হার্ট এ্যাটাকে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি চারজনের একজন কখনোই হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নেবার সুযোগ পাবেন না। বাকী তিনজন যখন কোন আধুনিক হাসপাতালে পৌঁছাবেন তখন যদি ১২ ঘন্টার বেশি দেরি হয়ে যায় তাহলে হৃদপিন্ডের মাংসপেশির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। কোটি টাকা ব্যয় করে এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে বিদেশে নিয়ে গিয়েও চার পয়সার লাভ হবে না। কারণ হৃদপিন্ড ও মস্তিষ্কের কোষ বা টিসু যদি একবার ধ্বংস হয় তাহলে তা হয় অফেরতযোগ্য এবং অপরিবর্তনযোগ্য।অর্থাৎ সময়ই এখানে মুখ্য নিয়ামক। টাইম ইজ লাইফ!

যদি রোগীটি প্রাথমিক ধাক্কা সামলে বেঁচে যান তাহলেও তার জন্য অপেক্ষা করছে সারাজীবনের মত অসহায় দুর্বল এবং অন্যের উপর নির্ভরশীল সংক্ষিপ্ত এক জীবন।

২। এবার আসি মানসিক অভিঘাত বিষয়ে। হার্ট এ্যাটাক এমনই এক অকস্যাৎ আঘাত যে ,এর জন্য কেউই মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে না। তাই যখন সেটি আসে তখন রোগী দিশেহারা হয়ে পড়ে। মৃত্যুভয় তাকে আঁকড়ে ধরে। রোগী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এধরণের রোগীর হৃদস্পন্দন অনিয়মিত হবার সম্ভাবনা বেশি। হার্ট ফেইল্যুর এবং হঠাৎ মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়। প্রাথমিক ধাক্কা সামাল দিতে পারলেও দীর্ঘমেয়াদী হতাশা এবং অবসাদ রোগীকে ঘিরে ধরে। জীবন ও কাজের প্রতি অনীহা ও বিরাগ রোগীর মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়, রোগীর আয় ইনকাম কমে সমগ্র পরিবারটিকে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত করে।

৩। উচ্চবিত্তের জন্য সমস্যা না হলেও দেশের বিপুল অধিকাংশ মানুষ সীমিত আয় দিয়ে সংসার নির্বাহ করে। তাদের জন্য হঠাৎ করে দেড় দুই লক্ষ টাকা যোগাড় করা সহজ নয়। ফলে বেশিরভাগ মানুষ গচ্ছিত সহায়সম্বল বিক্রি করে চিকিৎসা নিতে আসে। যারা নিম্ন আয়ের তারা কোনমতে সাধারণ হাসপাতালের চিকিৎসা গ্রহণ করে যা সবসময় মানসম্মত হয় না। যদি কখনো রোগীর লাইফ সাপোর্টের প্রয়োজন পড়ে তাহলে নিয়তির হাতে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোন পথ থাকে না।

আর্থসামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বাস্তবতা:

গেল বছর রাজস্ব বোর্ডের হিসেব অনুযায়ী একটি জর্দা কোম্পানী দেশের সর্বোচ্চ করদাতার সম্মান ও গৌরব লাভ করেছে। আরেকটি জরিপের রিপোর্ট মতে দেশের পূর্ণবয়স্ক (১৮ থেকে তদোর্ধ্ব) পুরুষ জনসংখ্যার শতকরা ৪৩ জন ধূমপানে আসক্ত। দেশের সর্ববৃহৎ সিগারেট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং বিভাগ আগামী দু’বছরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে এই সংখ্যা ৫০-এ উন্নীত করার। এ লক্ষ্যে তারা টার্গেট হিসেবে মাধ্যমিক পাশ করা ছাত্রদের যারা উচ্চমাধ্যমিকে পড়তে যাবে তাদেরকে নির্ধারণ করেছে। এবং এলক্ষ্যে তারা কলেজে কলেজে বিভিন্ন ধরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যেমন- ব্যান্ড সংগীত, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ইত্যাদি ব্যাপকভাবে স্পন্সরশীপ করার পরুকল্পনা গ্রহণ করেছে।
এর বাইরে কেউ যদি মফস্বলে গ্রামে গঞ্জে নজর রাখেন তাহলে দেখতে পাবেন প্রতি বছর শত শত কোটি টাকার পানের চাষ, সুপারির উৎপাদন , তামাক চাষ এবং এগুলোকে ঘিরে হাজার কোটি টাকার বিশাল বাজার সারা দেশব্যাপী আবর্তিত হতে থাকে।
এইযে দুটো ঘটনা-জর্দার গৌরব এবং সিগারেটের সম্মান , আমাদের জাতীয় জীবনে যে কলঙ্কের তিলক এঁকে দিল সেটা নিয়ে আমরা কী ভাবছি?

আমরা বলছি ধূমপান খারাপ, তামাক ক্ষতিকর। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্র দু’টিকেই নানানভাবে উৎসাহ উদ্দীপনা দিয়ে যাচ্ছে। তামাক রাষ্ট্রকে কোটি কোটি টাকা কর দিচ্ছে। কিন্তু বিনিময়ে হাজার হাজার কোটি টাকা কেড়ে নিচ্ছে। অন্যভাবে। আমাদের শরীর ধ্বংস করে। হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যানসার, ব্রংকাইটিস, অ্যাজমা, গ্যাংগ্রীন আমাদের উপহার দিচ্ছে। আমাদের জীবনীশক্তি নিঃশেষ করছে। আবার এসবের চিকিৎসার জন্য বহুগুন টাকা খরচ করছি। তাহলে রাষ্ট্র এটিকে নিষিদ্ধ করছে না কেন? কোটি কোটি টাকার কর পাচ্ছি। কিন্তু হাজার হাজার কোটি টাকার ধ্বংস চোখে পড়ছে না। এই যে স্ববিরোধিতা , দ্বিমুখী নীতি , এটাই হল পূঁজিবাদের উদগ্র লোলুপ জিঘাংসা।

প্রতিরোধই মূল লক্ষ্য:

স্বাধীনতার পরে আমাদের স্বাস্থ্য খাতে যতটুকু উন্নতি হয়েছে তার সিংহভাগই হয়েছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায়। যে কারণে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভ্যাকসিন প্রদান ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় সবার উপরে। এখন আমাদের হৃদরোগ সহ অন্যান্য রোগের প্রতিরোধের দিকে নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে জনসচেতনতাই প্রধান নিয়ামক। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে একযোগে একলক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে। বিশ্ব হার্ট দিবসে তাই এবারের মূল প্রতিপাদ্য হল “ একজন হার্ট হিরো হন, প্রতিজ্ঞা করুন “।

ক। প্রতিজ্ঞা আমাদের পরিবারের প্রতি: স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে খাবার রান্না করব। সবাই স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাব।

খ। প্রতিজ্ঞা আমাদের সন্তানদের প্রতি: তাদেরকে ধূমপান পরিহারে এবং নিয়মিত ব্যায়ামে উদ্বুদ্ধ করব।

গ। প্রতিজ্ঞা আমাদের রোগীদের প্রতি: তাদের রক্তের কোলেষ্টেরল কমাতে, ব্যায়াম করতে এবং ধূমপান পরিহারে উদ্বুদ্ধ করব।

ঘ। প্রতিজ্ঞা নীতিনির্ধারকদের প্রতি: যারা আমাদের স্বাস্থ্যবিষয়ক নীতিনির্ধারক তাদেরকে হৃদরোগ প্রতিরোধে ধূমপান, তামাক চাষ নির্মূলে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করব।

 

ডা. মাহবুবর রহমান
DMC K40
Senior Consultant Cardiologist
Labaid Cardiac Hospital

Urby Saraf Anika

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ আর্মি মেডিকেল কোর

Fri Sep 27 , 2019
বাংলাদেশ আর্মি মেডিকেল কোরের একটা বিস্ময়কর ইতিহাস আছে। এই কোর স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করা কোর। ১৪ জন অফিসার সহ সর্বমোট ১৩৮ জন শহীদ হন এই কোর থেকে যা সেনাবাহিনীর অন্যান্য কোরের মধ্যে সর্বোচ্চ। খেতাব প্রাপ্ত নারী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম স্যার এই কোরেরই এক জন […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo