প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৫ই নভেম্বর, ২০২০, রবিবার
লেখাঃ ডা. আহমেদ শরীফ শুভ
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান
প্রাক্তন ছাত্র, চমেক
চট্টগ্রামে একটি পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার হাসপাতাল স্থাপনের সরকারি সিদ্ধান্ত ব্যাপকভাবে জননন্দিত হয়েছে। এই প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে এই হাসপাতালটি কেবলমাত্র চট্টগ্রামেরই নয়, আশপাশের জেলাগুলোর ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসায়ও অসামান্য অবদান রাখবে। ক্যান্সার চিকিৎসায় জড়িত বিশেষজ্ঞসহ সাধারণ চিকিৎসক সমাজের মধ্যেই এই সামগ্রিক ক্যান্সার চিকিৎসায় যুগান্তকারী পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। কেবলমাত্র হাসপাতালের স্বপ্ন নয়, তারা দেখছেন বিস্তৃত ক্যানভাসের দূরদর্শী স্বপ্ন।
ক্যান্সার চিকিৎসায় প্রয়োজন মাল্টিডিসিপ্লিনারি এপ্রোচ। এই চিকিৎসা কেবলমাত্র রেডিওথেরাপি কিংবা কেমোথেরাপিতেই সীমাবদ্ধ নয়। একটি পূর্ণাঙ্গ সার্জারি ইউনিটও তার আবশ্যিক অংশ। কেননা কোলনের ক্যান্সার চিকিৎসায় প্রয়োজন হয় ইমিউনোথেরাপি, তার ব্যবস্থা থাকাও আবশ্যিক। আমাদের দেশে ক্যান্সার চিকিৎসায় অবহেলিত থাকে সাইকোথেরাপি ও পুষ্টিবিদের অংশগ্রহণও। একজন ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় পুষ্টিবিদ ও সাইকোলজিস্টের ভূমিকা অপরিসীম। সেই সাথে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রয়োজন রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার। এ ধরণের একটি রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারের জন্য প্রয়োজন ব্যাপক পরিসরের খোলামেলা জায়গা। বিপুল অর্থব্যয়ে এমন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করলে তা শুধুমাত্র চিকিৎসাসেবার কাজে ব্যবহার না করে ক্যান্সার চিকিৎসায় জড়িত চিকিৎসক ও অন্যান্য চিকিৎসাপেশাজীবীদের স্নাতোকোত্তর প্রশিক্ষণের কাজে লাগানোও অভিপ্রেত। এই হাসপাতালকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট। সেই সাথে সম্ভাবনা থাকবে ক্যান্সার গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার। প্রশিক্ষণ এবং গবেষণা ছাড়া যেমন চিকিৎসার উন্নয়ন সম্ভব নয়, ঠিক তেমন উদ্দেশ্যমুখী (পারপাস বিল্ট) হাসপাতাল ছাড়াও প্রশিক্ষণ ও গবেষণার পূর্ণতা সম্ভব নয়। সেই সাথে থাকতে হবে গবেষক, প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণার্থীদের আবাসন ব্যবস্থা। রোস্টার ডিউটিতে থাকা চিকিৎসক ও অন্য পেশাজীবীদের জন্যও আবাসনের ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। থাকতে হবে গাড়ি পার্কিং ও স্টপেজের পর্যাপ্ত স্থান।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্যান্সার দীর্ঘমেয়াদি ও চলমান রোগ। রোগীদের বারবার হাসপাতালে আসতে হয়। বাংলাদেশের চিকিৎসা অবকাঠামোর প্রেক্ষিতে ও অন্যান্য পারিবারিক ও সামাজিক কারণে রোগীর সাথে হাসপাতালে আসতে হয় কোন না কোন এটেন্ডেন্টকে। অনেক রোগী আসবেন বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে, অনেকে আসবেন ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে। রোগী ও এটেন্ডেন্টরা আসবেন দূর দূরান্ত থেকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের পক্ষে দিনে এসে দিনে ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না। ভর্তি হওয়া রোগীদের এটেন্ডেটদেরও থাকতে হবে হাসপাতালের কাছাকাছি কোথাও। সেজন্য ক্যান্সার হাসপাতালের অনতিদূরে অপেক্ষমাণ ও প্রত্যাবর্তনকারী রোগী ও তাদের এটেনডেন্টদের জন্য বিভিন্ন শ্রেণির স্বল্পমেয়াদি আবাসনের ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। সরকারিভাবে এই ব্যবস্থা করা গেলে তা যেমন রোগী ও তাদের পরিবারের ভোগান্তি কমাবে তেমনভাবে তার মাধ্যমে হাসপাতাল তহবিলে কিছু অর্থেরও সংস্থান হবে। এই স্থাপনার জন্য প্রয়োজন হবে বিস্তৃত পরিসর।
বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে আমরা ঢাকার আধুনিকায়ন, পদ্মা সেতু ইত্যাদিসহ আমাদের বহুদিনের লালিত অনেক স্বপ্নই বাস্তবায়িত হতে দেখেছি। সে জন্যই আমরা স্বপ্ন দেখার ব্যাপারে আরো সাহসী হতে পারছি। চট্টগ্রামে প্রস্তাবিত ক্যান্সার হাসপাতাল নিয়েও তাই আমরা সাহসী স্বপ্ন দেখতে চাই। আমরা দেখতে চাই ক্যান্সার হাসপাতালকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠুক একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ক্যান্সার চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র।
এ ধরণের প্রস্তাবিত একটি ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজন হবে ব্যাপক পরিসর। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে যা কোনভাবেই সম্ভব নয়। এই প্রাঙ্গণটি ইতিমধ্যেই একটি ইট-পাথরের শহুরে বস্তিতে পরিণত হয়েছে। যেটুকু খালি জায়গা আছে সেটুকুতে ক্যান্সার হাসপাতাল স্থাপন করলে তা হবে পরিবেশের জন্য শ্বাসরুদ্ধকর। শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়া, বদ্ধ পরিবেশে তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণের ঝুঁকি, বিদ্যমান যানজটের মারাত্মক অবনতিসহ অন্যান্য নেতিবাচক প্রভাবের কথা বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ও বিদগ্ধজনের লেখায় এর মধ্যেই উঠে এসেছে। সেসব সীমাবদ্ধতার কারণে মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণ কিছুতেই পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার স্থান হতে পারে না। কিন্তু এই প্রাঙ্গণে হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে আমাদের বিস্তৃত ক্যানভাসের স্বপ্নের সবচেয়ে বড় অন্তরায় হিসেবে দেখতে পাচ্ছি। যে ক্যানভাসে থাকবে হাসপাতাল, গবেষণা কেন্দ্র, স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার, আবাসন প্রকল্প ইত্যাদি তা বাস্তবায়নে প্রয়োজন বিশাল উন্মুক্ত পরিসর।
মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গনে প্রস্তাবিত ক্যান্সার হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে যে আলোচনা চলছে তাতে মনে হয় কেউ কেউ ত্বরিত বাস্তবায়নযোগ্য মনে করে স্থানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছেন। কিন্তু মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে তড়িঘড়ি করে একটি স্থাপনা উঠিয়ে ক্যান্সার হাসপাতালের রূপ দিলে তা ভবিষ্যতে সম্প্রসারণের কোনো উপায় থাকবে না। আর তা হবে একটি অদূরদর্শী পদক্ষেপ। অনেকে হয়তো যুক্তি দেখাতে চাইবেন, যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে তাতে সবকিছু নিয়ে একটি সমন্বিত ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন এ মুহূর্তে সম্ভব নয়, করতে হবে পর্যায়ক্রমে। কিন্তু ধাপগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করতে হলেও পর্যাপ্ত পরিমাণ খালি জায়গার ব্যবস্থা থাকতে হবে, মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণ যার জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়।
ক্যান্সার হাসপাতালের প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের জন্য একনেকের অনুমোদন পেয়েছে। কিন্তু একনেকের অনুমোদনে প্রস্তাবিত হাসপাতালের স্থানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়নি। সুতরাং এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব-পক্ষের সাথে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের ব্যাপকভিত্তিক আলোচনার সুযোগ উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। এমন একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্তই সর্বোত্তম পন্থা। আমরা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে ক্যান্সার হাসপাতালের গতানুগতিক স্বপ্নের চেয়ে বিস্তৃত ক্যানভাসে সমন্বিত ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্রের স্বপ্ন দেখতে চাই। তার জন্য প্রয়োজন শহরের বাইরে বিশাল উন্মুক্ত স্থান।
তথ্যসূত্রঃ দৈনিক পূর্বকোণ