বুকে ব্যথা: বিলম্বে বিপদ সংকেত
মাহবুবর রহমান
সিনিয়র কনসাল্টে, ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট, ল্যাবএইড হাসপাতাল
হঠাৎ করে বুকে ব্যথা শুরু হলে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। বয়স তিরিশ হলে বুকে বা বুকের আশেপাশে যে কোন ধরণের ব্যথা বা অস্বস্তি হলে সেটা প্রথমে ধরে নিতে হবে হার্টের ব্যথা। কারণ হার্টের ব্যথা অন্য কোনো ব্যথা থেকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । এজন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, হার্টের সমস্যায় মৃত্যু ঝুঁকি অনেক বেশি। এবং হার্টের রোগের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো দ্রুত চিকিৎসা না নিলে হার্টের মাংসপেশী দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কিছু ঘটনা:
১। সাদেক সাহেবের বয়স সাঁয়ত্রিশ। একটি বেসরকারী টেলিভিশন এর পদস্থ কর্মকর্তা । অফিসে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এমন সময় বুকে ব্যথা অনুভব করলেন। কি করা উচিত বুঝে ওঠার আগেই ঘরের মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। তাঁকে দ্রুত কার্ডিয়াক হাসপাতালের জরুরুী বিভাগে আনা হলো। সেখানে একটি ইসিজি করেই ডিউটিরত ডাক্তার আমাকে ফোন দিয়ে বললেন- ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাক !
আমি ৩০০ মিগ্রাম ডিসপ্রিন (এ্যাসপিরিন) , ১৮০ মিগ্রাম টিকারেল এবং ৮০ মিগ্রাম এ্যাটোভা খাইয়ে দিয়ে দ্রুত সিসিইউ তে পাঠাতে বললাম। এদিকে এ্যানজিওগ্রাম করার জন্য ক্যাথল্যাব টীম কে প্রস্তুত হতে বললাম।
রোগী সিসিইউ তে প্রবেশ করা মাত্র দেখি বুকে তীব্র ব্যথা, শরীর ঘর্মাক্ত, প্রেসার কম, পালসের গতি বেশি। আমি পুরো বিষয়টি তাঁর স্ত্রীকে বলা মাত্র তিনি বললেন, “সবচেয়ে যা ভাল সেটা করুন, আমাদের কোন আপত্তি নেই। ওঁকে বাঁচান প্লিজ! “
অনতিবিলম্বে সাদেক সাহেবকে ক্যাথল্যাবে নিয়ে গেলাম। দ্রুত এ্যানজিওগ্রাম করে দেখি তাঁর সবচেয়ে বড় রক্তনালী (LAD) শতভাগ বন্ধ হয়ে আছে। আমি তৎক্ষণাৎ সেটি খুলে দিয়ে যাতে আবার বন্ধ না হতে পারে সেজন্য একটি রিং (Stent) বসিয়ে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে সাদেক সাহেবের বুকের ব্যথা কমে গেল, ইসিজি স্বাভাবিক হয়ে এলো, প্রেসার বাড়ল, পালস সীমার ভেতর চলে এলো। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে ২০ মিনিট সময় ব্যয় হলো। সিসিইউ তে একদিন রেখে মোট তিন দিনের মাথায় তাঁকে ছুটি দিয়ে দেয়া হলো।
পরবর্তী ফলো আপে দেখা গেল তাঁর হার্টের পাম্পিং সম্পূর্ণ স্বাভাবিক । পুরোপুরি উপসর্গমুক্ত। গত নয় বছর হয়ে গেল তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। কয়েকটি ওষুধ নিয়মিত খাচ্ছেন। কোনো সমস্যা নেই।
ঘটনা ২
মোখলেস সাহেব একজন কৃষিবিদ। বয়স পয়তাল্লিশ। মানিকগঞ্জে তাঁর একটি খামার আছে। প্রতি শুক্রবার সেটি দেখভাল করার জন্য তিনি সেখানে যান। লাউয়ের কচি ডগার সর্পিল ঢেউ তাঁকে স্বাগত জানায়। নিজের হাতে মূলা শাক তুলে ঝুড়িতে রাখছেন। মূলার মূল থেকে মাটির সরস সতেজ গন্ধ তাঁকে বিভোর করে। মোরগের রক্তিম উষ্ণিষে সূর্যের আলো বেঁকে গিয়ে তাঁর দিকে ঝলক দেয়। নিজেকে একজন সফল কৃষিবিদ মনে হয়। এমন সময় বুকের মাঝখানে তীব্র ব্যথা শুরু হলো। ঘাম দিয়ে বমির ভাব হলো। তিনি চোখে অন্ধকার দেখলেন। মাটিতে বসে পড়লেন। দ্রুত গাড়িতে করে উপজেলা স্বাস্হ্য কমপ্লেক্স এ নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হলো। কিন্তু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার না থাকায় এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হলো। সেখানে তাঁকে হার্ট এ্যাটাক ডায়াগনোসিস করে জমাটবাঁধা রক্ত গলাবার ওষুধ (streptokinase) দেয়া হলো। তারপর আরো উন্নত চিকিৎসা দেবার জন্য কার্ডিয়াক হাসপাতালে পাঠানো হলো।
সিসিইউ তে আসা মাত্র তাঁকে পরীক্ষা করে দেখলাম প্রেসার কম, ইসিজি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। আমি সময় নষ্ট না করে দ্রুত এ্যানজিওগ্রাম করে হার্টের রক্তনালী পরীক্ষা করে দেখার প্রস্তাব দিলাম। তাঁর পরিবার রাজি হলেন।
যথারীতি ক্যাথল্যাবে নিলাম। ডান হাতের ধমনী (radial artery) দিয়ে এ্যানজিওগ্রাম করে দেখি হার্টের ডান রক্তনালী ৯৯% বন্ধ হয়ে আছে। অনতিবিলম্বে একটি রিং পরিয়ে ব্লক অপসারণ করে দিলাম। কয়েক ঘন্টার মধ্যে প্রেসার বেড়ে স্বাভাবিক হলো। তবে শুরু থেকে ব্লক অপসারণ পর্যন্ত সময়টি দীর্ঘ হওয়ায় হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা কমে ৪০% এ নেমে এলো( স্বাভাবিক হলো ৫৫%)।
মোখলেস সাহেব গত চার বছর ধরে নিয়মিত চেক আপ করিয়ে যাচ্ছেন। আগের মত ভারী কাজ বা পরিশ্রম করতে না পারলেও দৈনন্দিন কাজকর্ম স্বাভাবিক ভাবেই করে যাচ্ছেন।
ঘটনা ৩
মোসলেম উদ্দিন কেরাণীগঞ্জের মানুষ। বয়স ষাট। ডায়াবেটিক রোগী। রাত দশটা থেকে হঠাৎ শ্বাসকষ্ট । বুকে কোনো ব্যথা নেই। পরিবারের লোকজন ভাবল অ্যাজমা এ্যাটাক হয়েছে। তাঁরা মোসলেম উদ্দিন কে রাত ১টার দিকে জরুরী বিভাগে নিয়ে এলেন। ইসিজি করা মাত্র দেখা গেল হার্ট এ্যাটাক। রোগীকে তৎক্ষনাৎ ভর্তি হতে বলা হলো। কিন্তু রোগী বা পরিবার রাজি না। তাঁদের বক্তব্য “ ছাছের কষ্ট অইছে, ছাছের ওছুদ দ্যান!”
যাই হোক অনেক বুঝাবার পরে এবং নেবুলাইজার দেবার পরেও যখন দেখল শ্বাসকষ্ট কমছে না, তখন বাধ্য হয়েই মোসলেম উদ্দিনকে সিসিইউ তে ভর্তি করা হলো।
আমার ডিউটিরত কার্ডিওলজিস্ট আমাকে রাত দেড়টায় মোসলেম সাহেবের খবরটি দিলেন। বললাম যদি তাঁরা রাজি থাকেন তাহলে জরুরী ব্লক অপসারণ ( primary angioplasty) করা যেতে পারে। কিন্তু কোনো মতে রোগী বা তাঁর পরিবার রাজি হলেন না। বাধ্য হয়েই দ্বিতীয় অপশন streptokinase দিতে বললাম। কিন্তু ওষুধ ব্লক অপসারণে ব্যর্থ হলো। সকালের দিকে রোগীর পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হতে শুরু করল। প্রেসার কমে গেল, পালস কমে গেল, কিডনীর কার্যকারিতা কমতে শুরু করল। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা অনেক কমে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই লাইফ সাপোর্টে দেয়া হলো।
দুদিন লড়াই করে প্রচুর টাকার বিল পরিশোধ করে রোগীর লোকজন হৃদস্পন্দনহীন মোসলেম উদ্দিনকে নিয়ে বাড়ি চলল।
ঘটনা ৪
কবীর হোসেন বায়ান্ন বছরের ডায়াবেটিক রোগী। অ্যাজমার সমস্যাও আছে। উত্তরায় বসবাস করেন। সারাদিন অমানুষিক পরিশ্রম করেন। নিজের পেশাগত কাজের বাইরেও নানান সামাজিক জনকল্যাণমুখী কাজের সাথে সম্পৃক্ত। কিন্তু নিজের স্বাস্থ্য বিষয়ে বরাবর উদাসীন। রাত ১২ টার সময়ে প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে বাসায় ফিরলেন। অ্যাজমার এ্যাটাক ভেবে ইনহ্যালার নিতে শুরু করলেন। শ্বাসকষ্ট না কমায় স্ত্রী তাঁকে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে যেতে বললেন। তিনি ইনহ্যালার রেখে নেবুলাইজার ব্যবহার করলেন। তা সত্বেও শ্বাসকষ্ট কমল না। অবশেষে কষ্টের মাত্রা সহ্যের বাইরে গেলে হাসপাতালে রওনা দিলেন। কিন্তু এরই মধ্যে সাতটি ঘন্টা পার হয়ে গেল। উত্তরার একটি হাসপাতালের একজন জুনিয়র ডাক্তার আমাকে রোগীর ইসিজি হোয়াটসঅ্যাপ এ পাঠিয়ে মতামত চাইলেন। ইসিজি খারাপ দেখে আমি রোগীকে দ্রুত শিফট করতে বললাম। আমি খারাপ কিছু আঁচ করে ক্যাথল্যাব প্রস্তুত রেখে পুরো টীম নিয়ে সকাল সাতটা থেকে অপেক্ষা করতে থাকলাম।
এক ঘন্টা পরে রোগী যখন পৌঁছালেন তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেছে। এমতাবস্থায় এ্যানজিওগ্রাম করতে হলে রোগীকে লাইফ সাপোর্টে নিতে হবে। তিনি রাজি হলেন না। রক্তের গ্লুকোজ ২৪। পটাশিয়ামের মাত্রা বিপজ্জনক মাত্রায় বেশি। বাধ্য হয়ে কনজারভেটিভ চিকিৎসায় থাকতে হলো। হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা কমে ৩০% এ নেমে এসেছে। ফুসফুস পানিতে তলিয়ে গেছে। আমরা অসহায়ের মত তাকিয়ে রইলাম।
প্রকৃতপক্ষে রোগীর ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাক হয়েছে। কিন্তু ডায়াবেটিস থাকায় তিনি কোনো ব্যথা অনুভব করেননি। হার্ট ফেইল্যুর হয়ে ফুসফুসে পানি আসায় তাঁর শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু তাঁর পাশাপাশি অ্যাজমা থাকায় তিনি ভুল বুঝে অ্যাজমার চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। দুঃখজনকভাবে এভাবে হার্ট এ্যাটাকের পর মহামূল্যবান সাতটি ঘন্টা অপচয় হয়ে যায়। এই সময়ে তাঁর হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা কমে প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকায় কিডনি আক্রান্ত হয় , ফলে পটাশিয়াম বেড়ে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায়। এতদসত্বেও লাইফ সাপোর্ট দিয়ে এ্যানজিওগ্রাম করতে রাজি না হওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাকের আধুনিক চিকিৎসা হলো এ্যানজিওগ্রামের মাধ্যমে রিং বসিয়ে ব্লক অপসারণ করা। সেটা না পেরে streptokinase দিয়ে চেষ্টা করলেও কোন লাভ হয়নি। ফলে চোখের সামনে দিয়ে মহামূল্যবান একটি জীবন অকালে ঝরে গেল।
শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ:
১। তিরিশ বছর বয়সের কোনো ব্যক্তির বুকে বা বুকের আশেপাশে কোনো ব্যথা হলে অবশ্যই গুরুত্বের সাথে নিতে হবে।
২। ডায়াবেটিক রোগীর স্নায়ু দুর্বল বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অনেক সময় রোগী ব্যথা অনুভব করেন না। তাই হার্ট এ্যাটাকের ব্যথাও ঠিকমত বুঝতে পারেন না।
৩। বুকে ব্যথা অনুভব না করলেও রোগী বুকে অস্বস্তি বা চাপ বা শ্বাসকষ্ট অনুভব করতে পারেন। সেটাকে অ্যাজমার এ্যাটাক হিসেবে ভুল বুঝলে চলবে না।
৪। যে কোনো ধরণের হঠাৎ তীব্র অসুস্থতা বোধ করলে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে। ইসিজি করে ডাক্তার দিয়ে নিশ্চিত করতে হবে।
৫। জরুরী অ্যানজিওপ্লাস্টি হলো হার্ট এ্যাটাকের আধুনিক চিকিৎসা । এতে মৃত্যুঝুঁকি কমে এবং পাম্পিং ক্ষমতা বজায় থাকে। যেকোনো ভাবে হোক সম্ভব হলে এটি প্রয়োগ করতে হবে।
৬। চিকিৎসকের উপর আস্থা রাখতে হবে। চিকিৎসকের উপদেশকে মেনে নিয়ে সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। অযথা সময়ক্ষেপণ করে পুরাতন চিকিৎসায় ফিরে যাওয়া ঠিক হবে না।
৬। রাত দিন যখনই হোক সমস্যার সাথে সাথে জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতালে যেতে হবে। সময়ক্ষেপণ হবে আত্নহত্যার শামিল।