প্ল্যাটফর্ম কাউন্সিলিং উইং এর নিয়মিত পর্ব , বৃহস্পতিবারের চিঠির আজ প্রকাশিত হচ্ছে ১১ তম পর্ব ।
(১)
মাঝে মাঝে আমিও পলাতক হই। সবকিছু ছেড়ে একেবারে বৃন্দাবনে পালাই। কিছু সময় নিজেকে নিয়ে ভাবতে, নিজের সাথে কথা বলতে ভালোই লাগে। জীবনের লক্ষ্য ঠিক করতে নিজের সাথে কথা বলার কোন বিকল্প নেই।
এমবিবিএস পাশের পর কি পড়বো তা নিয়ে আমার মাথায় এতবেশী প্যাঁচ লেগেছিলো যে সেটা কল্পনা করলে আমার নিজেকে ক্যাপুট মেডুসার সাথে তুলনা করতে ইচ্ছে করে। তখন হাজারটা সম্ভাবনা মাথায় কিলবিল করলেও কোনটাই মাথা থেকে চিরতরে বের হতো না।
ইন্টার্নীর সময় আমি যে ওয়ার্ডেই যেতাম সেখানে ভাইয়া আপুদের সাথে খাতির হয়ে যেতো। স্যারদের দেখে আমার আগ্রহ বেড়ে যেত, আমার তখন ওই সাবজেক্টটাই পড়তে ইচ্ছে করতো। কিন্তু আমার সামনে এমন কোন বটবৃক্ষ ছিলো না যে আমাকে তার ছায়ায় ডেকে নিয়ে বলবে, আমি আছি চিন্তা নেই, যা মন চায় কর, যেই সাবজেক্ট ভালো লাগবে সেটাই পড়। কেউ তখন আমাকে বুঝায়নি আমার জন্য কোনটা ভালো হবে, বিসিএস নাকি এফসিপিএস।
(২)
আমি বুঝতে পারছিলাম না আগে বিসিএস দিবো নাকি এফ সি পি এস। নাকি এক বছর কোন ক্লিনিকে খ্যাপ দিয়ে টাকা জমিয়ে এম.ডি বা এম. এস দিবো। দুয়েকবার বেসিক সাবজেক্ট এ পড়ার ইচ্ছে হলেও কারো থেকেই সেভাবে সাপোর্ট পাইনি। পারিবারিক ঝামেলা লেগেই ছিলো। কাজ বন্ধ রেখে চোখ মুখ বন্ধ করে যে পড়বো সেই সুযোগ আমার কখনোই হয়নি।
সবার সাথে নিজের প্ল্যানিং নিয়ে আলাপ না করলে আমার যেন ভাত হজম হতো না। আমি নানা জনকে জিজ্ঞেস করতাম, তাঁরা তাদের নিজেকে আমার জায়গায় বসিয়ে সিদ্ধান্ত দিতো, এই সবজেক্ট ভালো, ওই সাবজেক্ট খারাপ, এইটা পড়, ওইটা পড়িস না। কেউ যখন আমাকে বলতো, এহ, এইটা পড়া বাদ দে, তুই পারবি না, বিলিভ মী, আমার শ্রেফ মরে যেতে ইচ্ছে করতো।
সবাই বলতো, মেডিসিনে অনেক পড়াশোনা করতে হয়, এখানে যাওয়া যাবে না। ভাবলাম, সার্জারী ভালো অপশান হবে, তাই চোখ বন্ধ করে সার্জন হবার স্বপ্নে বিভোর হলাম। ওমা, এখানেও যা তা অবস্থা। হাত ভালো হাত খারাপ নামক একটা বিশেষন আমাকে একেবারেই শেষ করে দিলো। যে আমি বিশ্বাস করতাম পরিশ্রম করে হিমালয়কেও জয় করা যায় সেই আমিই কিভাবে যেন ডিমোটিভেটেড হয়ে গেলাম। বিশ্বাস করতে শুরু করলাম আমাকে দিয়ে সার্জারী শুধু নয় মেডিকেলের কোন শাখাতেই কিছু হবেনা।
আমি নিজের সাথে মধ্যরাত অব্দি কথা বলতাম, আমি চাইতাম কেউ একজন আমার কাঁধে হাত রেখে বলুক, না পারলে নাই, তবুও সার্জারীই পড়। নাহ! সেই কপাল সবার হয় না। আমি আমার পারিপার্শ্বিকতার কাছে কোন পরামর্শ চাইনি, চেয়েছিলাম সামান্য একটু সাপোর্ট। সেই প্রাপ্তি যোগ আমার বরাবরই শূন্য থেকেছে। ধ্রুবতারার সন্ধান খুব কম মানুষই পান!
(৩)
এনাটমীর মনসুর স্যার ছিলেন আমার সবসময়ের প্রেরনা। সব সময় আমার মনে হতো স্যার এর মতো শিক্ষক হওয়া যায় কিভাবে। এমবিবিএস পাশের পর যখন দেখলাম বেসিক সাবজেক্ট এর নাম শুনলেই কেউ কেউ নাক সিঁটকায় তখন তো আমার হায় হায় অবস্থা! বেসিকে নাকি ফাকিবাজ স্টুডেন্টরা আসে। যারা এখনো বেসিক সাবজেক্ট নিয়ে এই ধারনা পোষন করেন তাদের জন্য করুনা। এক মনছুর স্যার এর হাত দিয়ে কত হাজার ছাত্র ছাত্রী মেডিকেলের ঝরে পড়া থেকে রক্ষা পেয়েছে সেই হিসাব কি কেউ রাখে? আমাদের সিস্টেমেরও দোষ আছে। বেসিক সাবজেক্ট এর বেতন ক্লিনিক্যালের দ্বিগুন হওয়া উচিত বলেই আমি মনে করি।
সবাই যখন মেডিসিন, সার্জারী, গাইনী নিয়ে স্বপ্নে বিভোর আর বেসিক সাবজেক্টকে ডাক্তারিই মানেন না, তাদের কাছে আমার আফসোস, এই তোমরাই একদিন বলবে আমাদের বেসিক নাই।মেডিকেলের কোন ব্রাঞ্চই ছোট নয়, এই সত্য কথাটুকু আমাদের প্রজন্ম কবে বুঝবে?
ক্যারিয়ার সিলেকশান হবে নিজের ভালোবাসা থেকে, দুই চারজন বড়ভাই, বোন কিম্বা পরিবার এর ইচ্ছায় নয়। শুধু টাকা উপর্জন করাই যদি ডাক্তার হবার সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য হয় তবে বেসিক সাবজেক্টেও অনেক টাকা আয় সম্ভব যদি সেটা গবেষনাধর্মী কাজ হয়।
(৪)
এক সময় সাইকিয়াট্রিষ্ট হবার স্বপ্ন ছিলো। আমার এই প্ল্যানের কথা শুনে দুয়েকজন হাসাহাসি করল, পাগলের ডাক্তারা নাকি ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যায়। দাঁতে দাঁত চাপি। আমার হাসি আসে, সেদিন বেশী দূরে নাই যেদিন এই ধরনের কথা বলা মানুষগুলোই একে ওকে জিজ্ঞেস করবেন, আচ্ছা ভালো সাইকিয়াট্রিষ্ট কাকে দেখানো যায়? তিনি বেমালুম ভুলে যাবেন যে, এই ভালো সায়কিয়াট্রিষ্ট হবার সম্ভাবনাময় দু একজনকে তিনি নিজেই গলা টিপে মেরে ফেলেছিলেন।
আমার বাবা আমাকে একটাই শিক্ষা দিয়েছেন সেটা হলো, “শেয়ানা হলে টপ শেয়ানা হবা, ভালো হলেও টপ ভালো। ওই সব হাংকিপাংকি মাঝারি মানের কিছু হলে কিন্তু হবেনা, যেখানে যাবা টপ হতে হবে।”
তুমি রেডিওলজী, রেডিওথেরাপি, এনেস্থেশিয়া, ইএনটি, অপথালমোলজি, স্কিন ভিডি, অর্থোপেডিকক্স, ইউরোলজি, এন্ডোক্রাইনোলজি, বার্ন প্লাস্টিক সার্জারী, নিউরোলজী, কার্ডিওলজী,নেফ্রোলজি, ফিজিক্যাল মেডিসিন, এনাটমী, ফিজিওলজী, মাইক্রোবায়োলজি, ফার্মাকোলজী, পাবলিক হেলথ যাই পড়ো না কেন, সেটার প্রতি তোমার ভালোবাসা থাকা লাগবে। লেগে থাকলে সব হয়, ভালোবাসা থাকলে কোন সাবজেক্টে ভালো করা শুধুই সময়ের ব্যপার।
হোয়েন ইউ ওয়ার্ক, ইউ হ্যাভ টু বী স্টিকি অন ইট। তোমার কাজকে তোমার ভালোবাসতেই হবে। তুমি যেই সাবজেক্ট ভালোবাসবে সেটাই পড়বা, সেখানে টপ হতে পারলে সবাই তোমার দিকে তাকিয়ে গর্ব করবে, তুমি হবে সবার আইকন!
(৫)
আমার ওয়াইফ কার্ডিওলজী পড়তে চাইলো। আমি ওকে ইচ্ছে করেই বেশ কয়েকটা অপশান দিলাম। কার্ডিওলজীকে খারাপ আর অন্য সাবজেক্টকে ভালো হিসেবে তার কান ভারি করার চেস্টা করলাম। কিন্তু আমার চেষ্টা বিফল হলো। সে কার্ডিওলজীই বেছে নিলো। আমি জোর করিনি কিন্তু আমি তার ডেডিকেশানটা জাস্টিফাই করতে চেয়েছি। আমি জানি সে ভালো করবে, এটাই আমার বিশ্বাস। কারন আমি ওকে জাস্টিফাই করে দেখেছি কার্ডিওলজীর প্রতি তার ভালোবাসা আছে।
আমার নিজের বেলায় আমি দেখেছি, আমার ডেডিকেশান এর অভাব ছিলো। পারিবারিক সমস্যা আর হেল্পিং হ্যান্ডের অভাবের কারনে আমি নানা দিকে হাত বাড়িয়েছিলাম। আমি আমার লক্ষ্যে অটল থাকতে পারিনি বলেই নানা জনের কথায় মোটিভেটেড হয়ে নিজের লক্ষ্য ভুলে গিয়েছিলাম। নিজের খাওয়া নিজেকেই খেতে হবে নিজের পছন্দ অনুসারে। অন্য কেউ খাইয়ে দিলে নিজের পছন্দের খাওয়া পাওয়া হবে না। খাবার কষ্ট হয়তো কমবে কিম্বা পেটও ভরবে কিন্তু মন ভরবে না।
মেডিকেল প্রফেশানে ক্যারিয়ার তথা সাবজেক্ট সিলেকশান হচ্ছে প্রেম কিম্বা বিয়ে করার মতো। বী রিজিড অন ইউর চয়েস। বি ইউরসেল্ফ ইট ডাজ নট ম্যাটার হোয়াট আদারস সে।
লিখেছেন ঃ ডাঃ মৃণাল সাহা, প্ল্যাটফর্ম কাউন্সিলিং উইং চিফ
{ প্ল্যাটফর্ম কতৃপক্ষ এর অনুমতি ছাড়া লেখাটা কপি করা যাবে না।}