(১)
আমি যখন কোন কিছু পড়ি তখন সেটা পড়তে খুবই ভালো লাগে। সেই ভালো লাগার ঘোর সহসাই কেটে যায় যখন দুদিন যেতে না যেতেই সেটা আর মনে করতে পারি না। বিশেষ করে ওয়ার্ড রাউন্ডে স্যার যখন প্রশ্ন করেন আমি হাঁ করে স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকি, আমার মাথায় কিছুই আসে না যদিও কিছু আসে সেটা গুছিয়ে বলার মত দক্ষতা আমার হয়ে ওঠে না। অতঃপর আমি নিজে থেকেই চুপসে যাই! নিজের ভেতর কেমন যেন খালি খালি লাগে!
(২)
স্টুডেন্ট লাইফে আমি যখন পড়াশোনা করতাম না তখন দিনের পর দিন আমি টেনশান ফ্রি থাকতাম। আমার মনে হতো কি এমন কঠিন ব্যপার? একরাত পড়েই এক্সাম দিয়ে দেবো। অতঃপর এক্সাম দিয়ে আসতাম কি লিখতাম কে জানে তবে ভাইবাতে স্যার ম্যাডামের বকা শুনতাম। খুব একটা পাত্তা দিতাম না। এভাবে ভালোই চলছিলো।
(৩)
ঘটনা এক এর পর আমি যখন ভগ্ন হৃদয়ে বাসায় ফিরি তখন আমার কান্না আসে আমি বই খুলি, দেখি ওখানে অনেক কিছুই দাগানো আছে, আশেপাশে আমার নিজের হাতে টুকিটাকি নোটস ও করা আছে কিন্তু আমার এসব কিছুই মনে নেই। আমি মনে একটা শান্তি পাই, ধুর পারি নাই তো কি হয়েছে আবার পড়লে ঠিকই পারবো। কিন্তু নিজেকে নিজে আশ্বস্থ করার পরপরই নিজের যোগ্যতা নিয়ে দ্বিতীয় দফায় হতাশ হই, কেন পড়া জিনিস পারলাম না।
আমি চোখ বন্ধ করে কিছু সময় ভাবি আর স্টুডেন্ট লাইফের কথা মনে করি যখন আমার মনে হতো ধুর সবইতো পারি। পার্থক্য টা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি। আমি একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হই, যতক্ষন পর্যন্ত না আমি বুঝবো আমি কি পারি না ততক্ষন পর্যন্ত আমার শেখা হবে না। আর যখন আমি কিছুই পারবো না তখন অল্প কিছু পারলেই অনেক মনে হবে।
আমার স্টুডেন্ট লাইফের বইয়ের পাতা গুলো ছিলো স্বচ্ছ, ঝকঝকে, সেখানে কোন দাগ নেই। দাগ নেই তো ষেখাও নেই। বইয়ের পৃষ্ঠার স্মৃতিচিহ্ন গুলো নিজেকে নষ্টালজিক করে, সময় চলে গেলেও দাগ থেকে যায়। এই দাগ, বইয়ের এই মলিনতা, এগুলোই আমার কাছে অনুপ্রেরণা!
(৪)
এরপর আসি ভুলে যাওয়া নিয়ে। ভুলে যাওয়া মানেই শেষ নয়, ভুলে যাওয়া মানে শুরু। যেদিন থেকে আমি বুঝতে শিখেছি কি ভুলে গেছি সেদিনই সেটা পড়ে ফেলেছি। দ্রুত কোন রোগীর সাথে সেটাকে মিলিয়ে নিয়েছি কিম্বা কারো সাথে সেটা ডিসকাস করেছি। এরপর কিছুদিন যাবার পর মনে করতে চেষ্টা করে যখন দেখলাম এখনো কিছু জিনিস ভুলে যাচ্ছি তখন আবার পড়েছি। আমি খেয়াল করে দেখলাম কোন কিছুর কনসেপশান ১০০% ক্লিয়ার না হলে সেটা মনে থাকে না। আর এই ১০০% কনসেপশান ক্লিয়ার করতে গেলে এপ্লাইড নলেজের বিকল্প নেই।
কারো থেকে শুনে শুনে কিছু মনে রাখলে ১০০% কনসেপশান ক্লিয়ার হবে না। কাজেই টেক্সট বই পড়ার বিকল্প নেই। টেক্সট বই হলো বড় শিক্ষক আর রোগী হচ্ছে একটা বিশাল ক্যানভাস। বই আর রোগী বাদ দিয়ে যত কিছুই করা হবে সবই হবে গৌন!
কোন কিছু বারবার পড়লে আর বার বার এপ্লাই করলে তা ভুলে যাওয়ার রিস্ক একেবারেই কম। আমরা একটা বিষয় একবারেই শিখে ফেলতে চেষ্টা করি এটা ভীষন ভুল। যদি তাই হতো তাহলে এক এনিমিয়া আর জন্ডিস নিয়ে থিসিস হতো না, ওগুলো মেডিকেলের ফার্স্ট ইয়ারেই শেষ হয়ে যেতো!
(৫)
একজন শিক্ষক একটা স্টুডেন্টের পথ প্রদর্শক। তিনি স্টুডেন্টকে সঠিক রাস্তাটা চিনিয়ে দেন। আমার সৌভাগ্য আমি এমন মহানুভব কিছু শিক্ষক এর সান্নিধ্য পেয়েছি। আমার শিক্ষক যখন আমাকে নাম ধরে ডাকেন আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।
স্যার রাউন্ডে যখন প্রশ্ন করেন সেই প্রশ্ন গুলো পরবর্তীতে রিভিউ করলে কি পারি না, কেন পারি না কিভাবে পারবো সেই জবাব গুলো সহজেই পাওয়া যায়।
(৬)
আমি আমার চলার পথে অনেক সহকর্মী পেয়েছি যাদের সাথে কাজ করে কখনোই ক্লান্তি আসেনি। চেষ্টা করেছি একটা আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে, কেউ আমাকে নিরাশ করেনি। আমার সহকর্মীরা ভালো থাকুক।
আমি অনেক বেশী কৃতজ্ঞ আমার স্যারদের উপর যারা অল্প জানা আমাকে শেখার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন। সামান্য পারফর্মেন্সেও খুশী হয়ে অনেক বেশী কমপ্লিমেন্ট দিয়েছেন। আমার মস্তক চির অবনত তাঁদের চরন তলে।
ভালো থাকুক আমার রোগীরা, ভালো থাকুক আমার সহকর্মীরা, দীর্ঘায়ু হন আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকেরা।
………
ডাঃ মৃণাল সাহা
#বৃ্হস্পতিবারের_চিঠি_১৩