“মায়েশা মাহফুজা বুলবুলি.একটি বেসরকারী মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যাচের মেধাবী ছাত্রী । বেঁচে থাকলে হয়ত আর ছয় মাস পর নামের আগে ডাক্তার লিখতে পারত । কিন্তু সেটা আর সম্ভব হলো না । গত ২২ অক্টোবর সে আত্মহত্যা করে । কারণ টা ছিল ফাইনাল প্রফে পাশ করতে না পারা । যে মেয়েটি প্রথম এবং দ্বিতীয় পেশাগত পরীক্ষায় এক বারেই পাশ করে, তাঁর জন্য হয়ত এটা মেনে নেয়া কঠিন ছিলো । জীবনে ডাক্তার হয়াটাই কী সব? বাবা-মা, ভাই-বোন-বন্ধু এসব সম্পর্কের কী কোন মূল্য নেই?শুধু তাঁকে দায়ী করে কী হবে? এর পেছনে যারা ছিলো তারা তো ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে । অনেক বেসরকারী মেডিকেল কলেজে একটা অলিখিত নিয়ম করা আছে যে মোট ছাত্র-ছাত্রীর মাঝে ৫০% পাশ করাবে, নয়ত সেন্ট আপই করবেনা, ব্লক পোস্টিং এই যেতে দিবে না, কারণ এর থেকে বেশি ইন্টার্ন হাসপাতালে দরকার নেই । বেশি পাশ করানো মানে কলেজের আর্থিক ক্ষতিই ।এতে কারো কত টা ক্ষতি হল তাতে কারো কিছু যায় আসে না, কিন্তু যারা বুলবুলির মত মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসে তারা এসব মেনে নিতে পারে না । বুলবুলি স্কলার্শিপে পড়তো বেসরকারী মেডিকেলটিতে যে নূন্যতম যে খরচ আসত সেটাও দিতে পারত না( হোস্টেল ফী’র মাত্র ১০০০ টাকা দিত) । তারপরেও আত্মহত্যা কোন কিছুর সমাধান হতে পারে না । মেডিকেল লাইফে হতাশা থাকবে,কিন্তু একে ওভারকাম করতে হবে, ডাঃ হতে হবে “। – কয়েক দিন আগে আমার ইনবক্সে জমা হওয়া মেসেজের একটি ছিলো এটি । যিনি মেসেজ দিয়েছেন তাঁর সাথে মুঠোফোনেও কথা হয়েছে বার দুয়েক । মানুষটার কন্ঠের হাহাকার ছাপিয়ে যে উৎকন্ঠা ছিলো সে জন্যেই লিখছি আত্মহত্যার খবর দেয়া এ লেখার উদ্দেশ্য না ।
বেসরকারী মেডিকেল কলেজে কিছুদিন চাকরির সুবাদে বুঝেছি-বাংলাদেশের সব চেয়ে অসহায় ছাত্র-ছাত্রী বোধহয় এরা । বাংলাদেশে টাকার মালিক হলেই অশিক্ষিত নিচু জাতের কিছু লোক অন্যান্য সাইড বিজনেসের একটা হিসেবে ট্যাক্স বাঁচাতে, অবৈধ পয়সা জায়েজ করতে বেসরকারী মেডিকেল কলেজ দেয়( দুঃখিত সবগুলো বেসরকারী মেডিকেল কলেজ নয়, হাতে গোণা কয়েকটা) । এদের কাছে টাকাই মূখ্য, ছেলে মেয়েগুলোর পড়াশোনার ধার ধারে না, শিক্ষকেরা তাঁদের কাছে চেয়ার টেবিলের চেয়েও কম দামি । যে সব শিক্ষক তাঁদের স্বেচ্ছাচারিতার বাইরে গিয়ে কিছু করতে চায়, অনিয়মের বিরুদ্ধে একটা টু শব্দ করে বিনা নোটিশে কয়েক মূহুর্তেই তাঁদের চাকরি চ্যুত করে । ছাত্র-ছাত্রীদের নূন্যতম সুযোগ সুবিধা দেয়া দূরে থাক তাঁদের মাঝে সব সময় আতংক তৈরি করে রাখে, কথায় কথায় মোটা অংকের টাকা জরিমানা করে । এক শ্রেণীর দালাল শিক্ষক নিয়োগ দেয় যাদের দিয়ে মালিক পক্ষ নানা অনৈতিক কর্মকান্ড করায় (পরে কখনো বলব) । আইটেম-কার্ড-টার্ম সব খানে যে শিক্ষার্থীর লবিং আছে অথবা অন্য কোন উপায়ে এদের তুষ্ট করতে পারে সহজেই পার পেয়ে যায়, আর প্রফের সময় এদের ধরাবাঁধা কিছু সিস্টেম আছে । এক্সটার্নালকে আপ্যায়নে আতিথেয়তা তো আছেই, প্রতিদিন ভাইভা শেষে গিফট দেয়, যে সকল শ্রদ্ধেয় এক্সটার্নাল এসব কিছু তে আপত্তি করেন তাঁদের জন্য অন্য ব্যবস্থা আছে । তারপরেও এই গুটিকয়েক বেসরকারী মেডিকেল কলেজ থেকে ভালো রেসাল্ট হয়-অনেকটা ছাত্রছাত্রীদের ব্যক্তিগত মেধায় তবে অনেক ক্ষেত্রেই কন্টাক্টে । (কন্টাক্ট মানে এখানে বলা যাচ্ছে না) । যে ক্ষয়টা দেখা যায় না সেটা হলো এই ছেলে মেয়েগুলো-আজ হয়ত একজন বুলবুলির কথা আমরা জানছি এরকম হাজারটা বুলবুলি ভেতরে ভেতরে মরে গেছে অনেক আগেই-বিপথগামী হয়েছে অনেকেই । এদের কারনেই বেসরকারী মেডিকেল কলেজ সম্পর্কে অনেক নেতিবাচক প্রচারণা, যার কোনটার জন্যই এই ছেলে মেয়েরা দায়ী না । স্বেচ্ছাচারী কর্তৃপক্ষ যে অনেক ক্ষমতাবান, কিন্তু ক্ষতিটা হয় দেশের, সামগ্রিক চিকিৎসা সেবার । আমরা আর একজন ও বুলবুলি চাই না, আপনার মেয়ে, বোন, বন্ধু আর কাউকে যেন বুলবুলি হতে না হয় ।
লেখক- মোহিব নিরব