ডা. সুরেশ তুলসান।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ।
শিক্ষার বাণিজ্যিক করনের সাথে সাথে কখন যে চোখের নিমিষেই চিকিৎসা শিক্ষার মত বিষয়টাও হঠাৎ করেই বাজারের পন্যে পরিণত হয়ে গেল আমরা বুঝতেও পারলাম না।যখন বোধোদয় হলো ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে।
আমরা প্রতিবাদ করে ছিলাম কিন্তু রুখতে পারলাম না, এবং একসময় অবশেষে মেনেই নিলাম, অনেকটা অপ্রিয় কোন কিছুতে বাধা দিতে পারার ক্ষমতা না থাকার কারনে সেই অপ্রিয় বিষয়টাকেই উপভোগ্য করে তোলার মত অবস্থা।
সেদিন আমরা যারা প্রতিবাদ করে ছিলাম আজ তাদের অনেকেরই আত্বিয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সন্তান-সন্ততি, তথা অনেক নিকটজনই এখন বেসরকারি মেডিকেল থেকে পাশ করা ডাক্তার।
বেসরকারি মেডিকেল থেকে পাশ করা অনেক ডাক্তারই এখন চিকিৎসা শাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন সহ সুনামের সাথে নিজ পেশায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেশে এবং আন্তর্জাতিক অংগনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছেন।
তাই নি:সন্দেহে বলাই যায় বেসরকারি মেডিকেল কলেজ সমুহ আমাদের চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য না হলেও অবিচ্ছেদ্য অংগে পরিণত হয়েছে।
এখনতো অনেক বেসরকারি মেডিকেল কলেজে উচ্চতর ডিগ্রীও সু্যোগ সৃষ্টি হয়েছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজ সমুহ চালু হওয়ার পর থেকে অনেকদিন পর্য্যন্ত তারা নিজেরাই নিজেদের মত করে ভর্তি পরীক্ষা নিত।
ভর্তিচ্ছুদের সংখ্যা আসনের তুলনায় বেশী হলে বিভিন্ন প্রকার অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি, মেধাক্রম না মানা, বছর বছর ভর্তি ফি বৃদ্ধি, বিভিন্ন খাত, অজুহাত এর নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায় ইত্যাদির অভিযোগ ছিল নিত্য -নৈমিত্তিক ব্যাপার।
আর ভর্তিচ্ছুদের সংখ্যা আসনের তুলনায় কম হলে বারে বারে ভর্তির আবেদনের তারিখ ও ভর্তি পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন। একাধিক বার ভর্তি পরীক্ষা নেয়া। একজন – দুজনের জন্য টোকেন পরীক্ষা নেয়া। এমনকি ” First come first service basis ” অর্থাৎ আগে আসলে আগে পাইবেন ( ভর্তি হইবেন ) ইত্যাদি। ভর্তি ফি / টিউশন ফি এর ক্ষেত্রেও বিভিন্ন রকম ছাড় / অফার / কিস্তি সুবিধা।
উভয় ক্ষেত্রেই সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ভর্তির জন্য নুন্যতম মানদণ্ড বজায় রাখা ছাড়া অন্য কোন স্টান্ডার্ড না মানার অভিযোগ।
দিনে দিনে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে এবং বেসরকারি মেডিকেল গুলো নিজেদের মত করে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ায় দেখা দিল নুতন নুতন বিপত্তি।
দেশে কোখায় কতগুলো বেসরকারি মেডিকেল কলেজ আছে, কোনটা বৈধ, কোনটা অবৈধ, বি এম ডি সি অনুমোদন আছে কি নাই ইত্যাদির খোজ খবর রাখা, কবে কোথায় আবেদন পত্র জমা দেয়ার শেষ দিন, কবে কোথায় ভর্তি পরীক্ষা ইত্যাদি বেশ ঝামেলা।
প্রত্যেকটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে আলাদা আলাদা আবেদন পত্র পাঠানো, এক কলেজ থেকে আরেক কলেজ ঘুরে ঘুরে ভর্তি পরীক্ষা দেয়া অভিভাবক এবং ছাত্র- ছাত্রীদের জন্য বড়ই বিড়ম্বনার বিষয় হয়ে দাড়ালো। তা ছাড়া জায়গায় জায়গায় ভর্তি ফরমের মুল্য, পরীক্ষা ফি , ভ্রমন ব্যয়, সময়ের অপচয়, ভ্রমনের ঝুকি ইত্যাদি।
অত:পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে সকল সরকারী – বেসরকারি মেডিকেল কলেজের একই দিনে একই সময়ে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হল। SSc র GPA, HSc র GPA ও ভর্তি পরীক্ষার মুল্যায়ন এই তিনটিকে একত্রে বিবেচনা করে একটা Scoring system ঠিক করে একটা পাশ মার্ক নির্ধারন করা হলো। এর বেশী যারা পাবেন তারা যেকোন বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তি হতে পারবেন, তবে ঐ নির্দিষ্ট মেডিকেলে যারা যারা ভর্তির জন্য আবেদন করবেন তাদের মধ্যে মেধাক্রম ঠিক রাখতে হবে।খুবই প্রশংসার যোগ্য উদ্যোগ।
কিন্তু দুই রকম বিপত্তি ঘটলো। প্রথমত এত বিপুল সংখ্যক মেডিকেল কলেজে কে কোথায়, কখন, ভর্তির জন্য আবেদন করছে, আর কলেজ গুলো মেধাক্রম ঠিকমত মানছে কিনা, তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষে খবরদারি করা কঠিন হয়ে উঠলো। দ্বিতীয়ত, পাশ মার্ক নিয়ে উত্তীর্ণ ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা পর্য্যাপ্ত হলেও অধিকাংশেরই লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে বেসরকারি তে ভর্তির সামর্থ্য না থাকায় অনেক বেসরকারি মেডিকেল ভর্তি হওয়ার মত ছাত্র-ছাত্রী পেল না।
সুতরাং ব্যবসায় মন্দা। কমানো হল পাশ মার্ক। তাতেও অভাব ঘুচলো না। পরে বাধ্য হয়ে বলা হলো ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী যে কোন ছাত্র- ছাত্রীকে যে কোন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ভর্তি করতে পারবে। তাহলে কি দরকার ছিল পরীক্ষা নামক প্রহসনের।
পরের বছর ভর্তি পরীক্ষার চিত্র কিন্তু সম্পুর্ন ভিন্ন। পরীক্ষা শেষে সকল, এমনকি অতি সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীও পরম তৃপ্তির হাসি নিয়ে পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে আসলো। প্রশ্নপত্র অতীব সহজ। ফলাফল awesome। এত বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি পরীক্ষায় কৃতকার্য্য হলো যে প্রাইভেট গুলোর ব্যাবসা রমরমা। নিন্দুকেরা বলাবলি শুরু করলো যে প্রাইভেট গুলোর ব্যবসায়ীক স্বার্থ বিবেচনা করেই নাকি ওদের সাথে যোগসাজসে প্রশ্নপত্র সহজ করা হয়েছে।
ধরনটা যেমনই হোক ভর্তির যোগ্যতা শিথিল করা অথবা বেশী সংখ্যক পাশ করানোর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন পত্র সহজ করা। উভয় ক্ষেত্রেই টাকার কাছে হার মানলো মেধা। আমরা জেনে শুনেই আমার, আপনার এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চিকিৎসার ভার তুলে দিচ্ছি অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতা সম্পন্ন অথবা অযোগ্য ছাত্র- ছাত্রীদের হাতে।
এখন আসি ভর্তি ফি নিয়ে। শুরুতে বেসরকারি মেডিকেল এর ভর্তি ফি ও আনুষঙ্গিক খরচ সহনীয় পর্যায়েই ছিল। পরে দিনে দিনে বেসরকারি মেডিকেল এর প্রতি মানুষের আস্থা স্থাপন ও চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে এবং মালিকদের অতি লোভ, মুনাফা, ব্যবসায়ীক মনোভাব এর কারনে খরচ প্রতিবছর বাড়তে বাড়তে একসময় লাগামহীন হয়ে উঠলো।
সরকারি মেডিকেল এ ভর্তির সময় ভর্তি ফি ও অন্যান্য খরচ সহ লাগে কয়েক হাজার টাকা, সেখানে বেসরকারি মেডিকেল এ লাগে লক্ষ লক্ষ টাকা।
সরকারি তে প্রতিমাসে বেতন, হোস্টেল ফি ইত্যাদি তে লাগে কয়েক টাকা, সেখানে বেসরকারি তে লাগে হাজার হাজার টাকা। উভয় ক্ষেত্রেই কয়েকশো গুন বেশী। অতপর সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজ সমুহের ভর্তি ফি ও অন্যান্য খরচের একটা উর্ধ্বসীমা ও নিম্নসীমা নির্ধারণ করে দিলেন। তবে খুব কম সংখ্যক ক্ষেত্রেই নুন্যতম ফি নেয়া হয় বলে শুনি।
চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবসায়ী দের অবৈধ অর্থ উপার্জনের আরেকটি খাত হলো বিদেশী ছাত্র কোটা। কোন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ প্রয়োজনীয় বিদেশী ছাত্র না পেলে সেই আসনে দেশী ছাত্র ভর্তি করতে পারে, তবে অবশ্যই উচ্চমুল্যে ( বিদেশী দের হারে)। এই ক্ষেত্রে কোন ভাবেই মেধাক্রম মানা হয় না এবং সাধারণত সবচেয়ে অযোগ্য স্বদেশী শিক্ষার্থীই ভর্তি হয় এই কোটায়।
প্রস্তাবনা সমুহ
————————–
১. একই সময়ে একই দিনে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে সকল সরকারি, বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি বহাল থাকবে।
২.ভর্তি পরীক্ষার আবেদনের সময় সকল সরকারি, বেসরকারি মিলিয়ে পছন্দক্রম দেয়ার সুযোগ থাকতে হবে। তা হোক না তা লম্বায় কয়েকশো, আজকের ডিজিটাল যুগে এটা কোন দাপ্তরিক সমস্যা হবে বলে মনে হয় না
৩. একজন শিক্ষার্থী কোন বেসরকারি মেডিকেল এ ভর্তি হবে সেটা যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে নির্ধারিত হতে হবে। দামের তারতম্যের এবং দাম দেওয়ার সক্ষমতার ভিত্তিতে নয়।
৪. চিকিৎসা শিক্ষার বাণিজ্যিক করন মেনে নিতেই অনেক কষ্ট হয়েছে আমাদের। দাম এবং দাম দেওয়ার সামর্থের ভিত্তিতে মানের তারতম্য কোন ভাবেই মেনে নেয়া যাবে না।
৫.সুতরাং সকল বেসরকারি মেডিকেল এর ভর্তির ক্ষেত্রে কলেজ পছন্দ অবশ্যই মেধার ভিত্তিতে হতে হবে এবং সকল বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তি ও আনুষঙ্গিক খরচ অবশ্যই সমান এবং সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হারে হতে হবে।
৬.সরকার যদি মনে করে কোন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ মান সম্পন্ন নয় এবং কোন ভাবেই মানের উন্নতি করা যাচ্ছে না। তাহলে কম দামে বাজারজাত করার চাইতে সেই কলেজ কে বন্ধ করে দিতে হবে।
৭. সরকার ইচ্ছে করলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ সমুহের কিছু আসন টাকা দিয়ে কিনে নিতে পারে। এবং এই সকল আসনে জাতীয় মেধা তালিকা থেকে প্রকৃত মেধাবী ছাত্র – ছাত্রী ভর্তি হয়ে সরকারী মেডিকেল এর মত অল্প খরচে পড়াশোনা করতে পারবে। একটি পুর্ণাংগ সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন করে MBBS এর আসনপ্রতি সরকারের যত টাকা খরচ হয়, এই পদ্ধতিতে আসন প্রতি সরকারের ব্যয় তার চাইতে অনেক কম হবে।
৮.কোন একজন শিক্ষার্থী কোন একটি বেসরকারি মেডিকেল এ ভর্তি হওয়ার পর অপেক্ষামান তালিকা হতে কোন সরকারি মেডিকেল এ ভর্তির সুযোগ পেলে তার ভর্তির সময় জমাকৃত সমুদয় টাকা ফেরত দিতে হবে।
৯.অনুরূপ ভাবে একজন শিক্ষার্থী কোন একটি বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তির হওয়ার পর তার পুর্ববর্তী পছন্দের কোন বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তির যোগ্য বিবেচিত হলে তাকে মাইগ্রেশন এর সুযোগ দিতে হবে। এবং তার ভর্তিকৃত কলেজে জমা কৃত সমস্ত টাকা তার মাইগ্রেশন কৃত নুতন কলেজে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করতে হবে।
১০. বিদেশী কোটায় শুধুমাত্র বিদেশী ছাত্র-ছাত্রীই ভর্তি করতে হবে। যদি কোন কারনে দেশী ছাত্র ভর্তি করতে হয় তবে তা অবশ্যই মেধাক্রম মেনে করতে হবে, এবং কোনভাবেই অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা যাবে না।
১১. কোন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ভর্তি সংক্রান্ত কোন আলাদা বিজ্ঞাপন দিতে পারবে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জারিকৃত বিজ্ঞাপনে সকল সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ এর তালিকা ও তথ্য দেয়া থাকবে। ফলে চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে শিক্ষার্থী দের বিভ্রান্ত হওয়ার আর কোন সুযোগ থাকবে না।