৮ এপ্রিল, ২০২০:
রবিবারে (০৫ এপ্রিল) চব্বিশ ঘন্টা ডিউটি ছিল হসপিটালে। সকাল সাড়ে নয় টায় PPE (জীবাণু প্রতিরোধী সুরক্ষা পোশাক) পাওয়ার পরই পেশেন্ট দেখতে দৌড় দিয়েছিলাম। পেশেন্টের ফলো-আপ, স্যারদের রাউন্ড এটেন্ড, নতুন পেশেন্ট রিসিভ করে, পোস্ট-অপের পেশেন্ট দেখে তারপর ওয়ার্ডে শিফ্ট করতে করতে সারাদিন গেছে।
শুধু সেলফি তুলার উদ্দেশ্যে এই ছবিটা তুলিনি। নিজের অসুস্থ আম্মুকে আশ্বস্ত করেছিলাম, তাঁর মেয়ে যতটুকু সম্ভব প্রোটেকশন নিয়ে ডিউটি করছে। করোনার দিনগুলোতে রোজা থাকি। খাবার জোগাড়ের ঝামেলা থেকে মুক্ত। কষ্ট হলেও মানিয়ে নিচ্ছি, মানিয়ে নিতে হয়।
প্রাইভেট জব। কোনো ভাতা পাব না। পারিবারিক চাপ আছে চাকরি ছেড়ে দেয়ার। একমাত্র মেয়ে বলে কথা!
কিন্তু চাকরি ছাড়ার কথা ভাবলে মনে হয়, যখন মানুষের আমাকে প্রয়োজন ছিল তখন পালিয়ে গেলাম! এই অনুভূতি নিয়ে নিজের কাছে মুখ দেখাবো কিভাবে?
ছবি: লেখক ও তার সহকর্মীরা
সাধারন ছুটির এই সময়ে যাতায়াতে সমস্যা। কিছুদূর হাঁটি, দ্বিগুণের বেশি ভাড়া গুনি। বেতন একই থাকে কিন্তু তারপরও ময়দান ছাড়িনি আমরা।
নানারকম কটুকথা শুনতে পাই। টিভি, ফেসবুক, ইউটিউব, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সমাজ কেউ বাদ রাখেনি সমালোচনা। কোন অগ্নিগর্ভ আগ্নেয়গিরির মুখে ডিউটি করে যাচ্ছি, তা শুধু আমরাই জানি! চূড়ান্ত উদাসীনতার মাঝে যেন এক প্রচন্ড বিস্ফোরণের অপেক্ষা।
PPE-র জন্য ওয়াশরুমে যাইনি, পানি খাইনি দীর্ঘসময়। কি বিকট গরম PPE এর মধ্যে তা বুঝতে হলে নিজেকে পলিব্যাগে আটকে দেখতে পারেন।
বাসায় বয়স্করা উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখ নিয়ে আছে। হাসপাতালে বিভিন্ন ধরনের রোগী দেখি। হরেক জীবাণুর আবাস যেন হাসপাতাল। আর আমাদের পরিবারের জন্য হয়ে উঠি ক্ষতিকারক। নিজের কথা ছেড়েই দিলাম, কর্তব্য যেহেতু পালন করতেই হবে। কিন্তু আমার কারণে পরিবারের কারো ক্ষতি হলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।
এতটা বিপদের মুখে দাঁতে দাঁত চেপে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সময় যখন শুনি আমাদের সুরক্ষা পোশাক মানসম্মত, ভাইরাস প্রতিরোধী নয়, কোথাও কিনতেও পাওয়া যায় না- খুব অসহায় লাগে।
এর মাঝে জানা যায় সমাজ-রাষ্ট্রের নানা পর্যায় থেকে তীর্যক কথা। তখন আর ভাল্লাগেনা। মনে হয়, বেশ তো থাকতে পারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে। তবে কাদের জন্য এত কষ্ট করি?
লেখকঃ
তাবাসসুম তামান্না অতসী
মেডিকেল অফিসার
সার্জারী বিভাগ,
আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।