০৮ এপ্রিল, ২০২০:
ডা. শোয়েব হোসেন
আজকে প্রায় ১৫ দিন প্রাইভেট প্র্যাকটিস করছি না। শুধুমাত্র রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই সকালের সময়টুকু রোগী দেখছি। চেষ্টা করছি সরকারি হসপিটালের সেবাটা খুব ভালো ভাবে দেওয়ার জন্য। পর্যাপ্ত পিপিই (জীবাণু প্রতিরোধী সুরক্ষা পোশাক) সংকটে ভুগছে উপজেলা হসপিটালগুলি। আমাদের হসপিটালটিও তার ব্যতিক্রম নয়। পিপিই না থাকায় প্রটেকশনের অংশ হিসেবে স্যার আমাদেরকে একটি গাউন, একটি মাস্ক, একটি গগলস দিয়েছেন। সেটা দিয়েই কোনভাবে কাজ চালিয়ে নিচ্ছি। আমি নিজেও প্রায় ৩ হাজার টাকার গ্লাভস, মাস্ক নিজ উদ্যোগে কিনেছি এবং আমার কলিগদের জন্যে প্রায় ১২ হাজার টাকার জিনিসপত্র ঢাকা থেকে আনিয়েছি। সবই আমাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে।
গত কয়েকদিন যাবৎ লক্ষ্মীপুর জেলা লকডাউন অবস্থায় রয়েছে। রাস্তাঘাটে খুব একটা গাড়ি চোখে পড়ে না। যার কারণে নিজের পুরাতন বাইকটি নিয়ে প্রায় ৩৪ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সে পৌঁছাই। সপ্তাহে দুইদিন নাইট ডিউটি থাকে। নাইটে ডিউটি করতে যাবার সময় চিরচেনা পথটিকে বড্ড ভুতুড়ে মনে হয়। তারপরও যেতে হয় কারণ ইমার্জেন্সি ২৪ ঘন্টাই খোলা। সেখানে ১০ মিনিট দেরি করে গেলে, একটা খারাপ রোগী আসলে, ডাক্তার না পেলে বড় বিপদ হয়ে যেতে পারে। পিপিই সংকটের কারণে পুরাতন রেইনকোটটিকে বড্ড আপন মনে হয়। পুরো রাতটা সেটাই পরে কাটিয়ে দিতে হয়। খোলার কোনো সুযোগ নেই কারণ সব সময়ই মনে হয় এই বুঝি জ্বর সর্দি-কাশি নিয়ে কোন রোগী ইমারজেন্সির ভেতরে ঢুকে পড়ল।
বুকটা দুরু দুরু করে। অনেকেই বলে ডাক্তার কাপুরুষ। হ্যাঁ আমি কাপুরুষ কারণ আমার বাসায় দুটো ছোট ছোট বাচ্চা আছে, আমার বৃদ্ধ বাবা-মা আছে। তাদের জন্য আমার মনটা কাঁদে। আমার যদি কিছু হয় আমার ফ্যামিলিটা বসে যাবে। নতুন চাকরিতে জয়েন করেছি, চাকরি এখনো স্থায়ী হয়নি। এমন অবস্থায় আমার যদি কোন কিছু হয়ে যায় তবে আমার ফ্যামিলির দায় ভার কে নিবে? কাপুরুষতা আমাকে ঘিরে ফেলেছে। পরাজয়ের গ্লানি আমাকে ভর করছে আর করবেই বা না কেন দেশের যে পরিস্থিতি! ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার। সারাদিন একটা কথাই মাথায় ঘুরপাক খায়, আমি কাপুরুষ!
দেশের সার্বিক পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রতিনিয়ত করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ডাক্তাররা আক্রান্ত হচ্ছে। মারাও যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী। আমি সরকারি ডাক্তার, সরকারের প্রতিনিধি। সরকারের জীর্ণশীর্ণ এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আমাকে আমার সর্বোচ্চ টা দিতে হবে। আমি দিতে রাজি আছি। আমি আমার জীবন দিয়ে দিব। শুধু একটাই অনুরোধ আপনার কাছে, আপনি আমার যোগ্য সম্মান টুকু আমাকে দেন। কর্মক্ষেত্রের ব্যবহার্য জিনিস গুলো আমাকে দেন। আমার জীবনের নিরাপত্তা দেওয়া লাগবে না, সেটা দিবে উপর ওয়ালা। কর্মক্ষেত্রে আমার অনেক ভাই-বোন হয়তো প্রতিনিয়ত ভুল ত্রুটি করে। তাদের দিয়ে আমার অন্যান্য ডাক্তার ভাই বোনকে বিবেচনা করবেন না। আমার ভুল গুলোকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখে, আমার মহানুভবতা কে সবার সামনে তুলে ধরুন। দেখবেন আমার কাজ করার আগ্রহ স্পৃহা আগের থেকেও অনেক গুন বেড়ে গেছে।
কাল (০৯ এপ্রিল) শব-ই-বরাতের ছুটি, পরশু শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি, পহেলা বৈশাখের ছুটি- দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে আমার তো কোনো ছুটি নেই। আমাকে ঠিকই আমার কর্মস্থলে যেতে হবে। উপরের নির্দেশ, আমি রাজি। কারণ, আমি সরকারি কর্মচারী। তারপরও যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার হসপিটাল নিয়ে পোষ্ট দেখি, ‘হসপিটালে কোন ডাক্তার নাই, সব ডাক্তার ছুটিতে।’ তখন মন খারাপ করি আর বলি আহ! আমিতো কাপুরুষ! এর প্রতিবাদ করা আমার সাজে না। মনকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি, ভালো-মন্দ যাই করিস উপরওয়ালার কাছে প্রতিদান পাবি।