প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২১ এপ্রিল, ২০২০, মঙ্গলবার:
রোগীর চাপ কমই ছিল। ক্ষুধা লেগেছে। প্লেট ধুয়ে খাবার নিয়ে বসেছি মাত্র। রুমে একজন রোগীর লোক এলেন। নতুন রোগী এসেছে। “ইসিজিটা করতে বলুন” বলে দ্রুত একটু খেয়ে উঠে গেলাম। রোগীর চিকিৎসা লিখলাম। বাকি খাবার কি আর এসে খাওয়া যায়?
আবার একটু অবসর। একটা প্রজ্ঞাপন দেখছিলাম আর ভেবে মনটা খারাপ হচ্ছিল। সরকারি চিকিৎসক/স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হলে/ মারা গেলে কীভাবে প্রণোদনা পাবেন তার বিস্তারিত। আমি এর অন্তর্ভুক্ত না। কারণ যদিও আমি সরকারি হাসপাতালে কাজ করি, কিন্তু আমি বেসরকারি ডাক্তার। বুঝে নিলাম আমার জীবনের একফোঁটা মূল্য নেই এদেশের কাছে। আমি আক্রান্ত হলে আমার দেখভাল করার কেউ নেই। আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হলে আমার পরিবারকে ন্যূনতম সান্ত্বনা দেওয়ার কেউ নেই, প্রণোদনা তো অনেক পরের কথা। নিজেকে এরচেয়ে ছোট, এরচেয়ে অচ্ছুত-হীন কখনও বোধহয় মনে হয়নি।
গত ১০ মাস ধরে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অন্যতম ব্যস্ত ওয়ার্ডে দিন-রাত এক করে কাজ করেছি। কখনও খাবার সময় পাইনি, কখনও কোমর ব্যথায় নড়তে পারিনি, কখনও অসীম ক্লান্তিতে বাসায় গিয়ে না খেয়ে ঘুমিয়ে গেছি, দরদর করে ঘামতে ঘামতে সেই শার্ট নিজে নিজেই আবার শুকিয়ে গেছে। কতো বিনিদ্র রজনী, কতো ঢুলুঢুলু ভোর, কতো ব্যস্ত দুপুর এদেশের মানুষের জন্যে দিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। সরকারের হাসপাতালে সেবা করেছি হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে। সপ্তাহে ৬-৭ দিন। হ্যাঁ, শুক্রবারসহ। সরকারি ছুটির দিনসহ। বিনিময়ে আমি গত ১০ মাসে কয় টাকা পেয়েছি জানেন? “০” টাকা। একটি টাকাও না। নিজের টাকায় বাসা ভাড়া দিই। নিজের টাকায় খাই। কিছু বললেই, ডিগ্রিতে আছো, সামনে স্পেশালিস্ট হবে, কার্ডিওলজিস্ট হবে…এই সান্ত্বনা…আচ্ছা আমি নাহয় একা মানুষ, যাদের সংসার আছে, দুটো বাচ্চা আছে, বৃদ্ধ মা-বাবা আছে তাদের সংসারটা কীভাবে চলে?
আমরা তরুণ ডাক্তাররা কী নির্মম জীবনযাপন করি কেউ কি ভেবে দেখে আদৌ? কেউ কি জানে আদৌ আমাদের এমবিবিএস পরবর্তী জীবনটা সম্পর্কে? আমার সামনে অনেকে মানবতা, দেশপ্রেম এসব বড় বড় বুলি দেয়। আমি মনে মনে হাসি। আরেহ আমার এই দশ মাসের সার্ভিসের মূল্য কতো লাখ টাকা হবে জানেন? এই এতো লাখ টাকা আমি দেশের জন্য মানবতার জন্য দিয়ে দিয়েছি এই সান্ত্বনা আমি নিজেকে দিই।
আমার আম্মু বলতো আমি ছোটবেলা থেকেই ছিলাম চাপা স্বভাবের। আমার আব্বু-আম্মুর কাছেই আমি সহজে কিছু চাই না। আর অন্য মানুষ তো অনেক দূরের কথা। তবুও মাঝেমাঝে হৃদয়টা ভেঙে যেতে চায় যখন দেখি এদেশ আমার জীবনের কোনো মূল্য দিলো না। আমাকে এক অথৈ সাগরে ফেলে দিয়ে আমাকে জাতির সেবা করতে পাঠিয়ে দিলো। খোঁজ নিলো না আমি কীভাবে চলব! আব্বু-আম্মু প্রতিদিন ফোন করে বলে বাবা বাসায় চলে আসো, তুমি কী খাও কীভাবে থাকো, আমাদের খুব চিন্তা হয়। আমি আব্বু-আম্মুকে মিথ্যে সান্ত্বনা দিয়ে, অনেক ভালো আছি বলে কেন যে এখানে পড়ে থাকি, আমি জানি না। এ কোন পাগলামি আমার? একদিন হয়তো সত্যি সত্যি সব ছেড়ে দেব।
লিখেছেনঃ
ডা. মারুফ রায়হান খান
কার্ডিওলজি বিভাগ
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল