১০ এপ্রিল, ২০২০:
(লিখেছেন ইটালিয়ান লেখিকা ফ্রান্সেসকা মেলানদ্রি। ভদ্রমহিলা কোভিড-১৯ এর কারনে রোমে তিন সপ্তাহ লক ডাউনে ছিলেন। তিনি লিখেছেন এই চিঠি, ‘তোমাদের ভবিষ্যৎ থেকে’। এতে তিনি সামনের দিনগুলোতে ব্রিটেনের নাগরিকদের ঠিক কি রকম আবেগের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে, সেই সম্পর্কে বলেছেন। কিছু কথা বাংলাদেশের জন্যেও প্রাসঙ্গিক।)
আমি লিখছি ইটালী থেকে, সেই অর্থে বলতে পারেন আমি লিখছি আপনার ভবিষ্যৎ থেকে। আমরা এখন যে সময়টায় আছি ঠিক এরকম একটা সময়ে আপনারা আর কয়েকদিনের মাঝেই চলে আসবেন। এজন্যেই আমি ভবিষ্যৎ থেকে বলছি। করোনা মহামারীর সমস্ত চার্ট, ডেটা দেখিয়ে দিচ্ছে আমরা সবাই একই পৃথিবীতে, একই সমান্তরালে থাকা একটা প্রাণীগোষ্ঠী।
চীনের উহান শহর, যেখান থেকে সবকিছুর শুরু, সেই শহর যেমন আমাদের শহরের চাইতে কয়েক সপ্তাহ এগিয়ে ছিলো, আমরাও এখন আপনাদের চেয়ে সেরকমই কয়েক সপ্তাহ এগিয়ে আছি। দেখতে পাচ্ছি, আমরা এই কয়েকদিন আগেও ঠিক যেরকম আচরণ করেছিলাম, আপনারাও ঠিক একই আচরণ করছেন। এই আচরণের মাঝে একদল বলছে, “এইটা শুধুই একটা ফ্লু, এতো ঘ্যামের দরকার কি?” আরেকদল এর মাঝেই ভাইরাসের ক্ষমতা সম্পর্কে বুঝে গেছে।
সেই ভবিষ্যত থেকে, আমরা দেখতে পাচ্ছি, আপনাদের অনেকেই যেমনটা করে বলা হচ্ছে, ঠিক সেভাবেই নিজেদের ঘরের ভেতর আটকে ফেলবেন, বেশ উদাস হয়ে দর্শন টর্শনের কথা বলবেন। কদিনের মধ্যেই যাবতীয় দর্শন উধাও হয়ে যাবে।
সবার আগে, এ সময়টায় আপনি খুব করে খাওয়া দাওয়া করবেন। ওর বাইরে কিছু করার নেই বলে খাবেন, ব্যাপারটা তেমন না। আপনি এমনি এমনিই খাবেন।
সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং গ্রুপ গুলোতে কিভাবে এই অখন্ড অবসর খুব সুন্দর ভাবে কাজে লাগানো যায়, সেরকম টিউটোরিয়াল আপনার হাতে চলে আসবে ভুরি ভুরি। মোটামুটি সবকয়টাতেই দেখা যাবে আপনি জয়েন করে ফেলেছেন, দিন কয়ক পর আপনিই ঐ ‘টিটোরিয়ালের খেতা পুড়ি’ বলে বসে থাকবেন।
পৃথিবী ধ্বংস বিষয়ক যত সাহিত্য, থ্রিলার-টিলার আছে, দেখা যাবে সবই আপনি বের করে পড়া শুরু করে দিয়েছেন, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে খুব দ্রুতই আপনি বুঝে যাবেন, এইসব পড়ার কোন মানে নেই।
তো ঘটনা কী হবে? আবার খাওয়া দাওয়া। ঘুম-টুমের ঘটিবাটি উড়ে যাবে। নিজেকে প্রশ্ন করা শুরু করবেন, এই ঘন্টার গণতন্ত্রের হয়েছে টা কি?
অনলাইনে মোটামুটি অপ্রতিরোধ্য একটা সামাজিক জীবন আপনার শুরু হবে-মেসেঞ্জার, হোয়াটস অ্যাপ, স্কাইপ, জুম…
নিজের বড় হয়ে যাওয়া সন্তানদের জন্যে আপনার খুব, খুব মায়া লাগা শুরু করবে, এতো মায়া এর আগে আপনার কখনোই লাগেনি। ওরা যদি আপনার সাথে না থাকে তখন হঠাৎ করেই মনে হওয়া শুরু করবে, ওদের সাথে আমার আর দেখা হবে তো? এই ভাবনাটা বুকের মধ্যে জমাট একটা বেদনাবোধের জন্ম দেবে।
পুরোনো বিরক্তি, মান-অভিমান সব মনে হবে অর্থহীন। যাদের সাথে এই জীবনে আর কোনদিন কথাই বলবেন না বলে পণ করেছিলেন, তাদেরকেই ফোন করে জিজ্ঞাসা করবেন, “কি রে কি খবর, ভালো আছিস?” অনেক গৃহিনী বাড়ীতে থেকে থেকে মার খাবেন।
যাদের নিজের একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, তারা কোথায় থাকবে, ভেবে আপনার খুব দুশ্চিন্তা হবে। ফাঁকা শ্মশানের মতো রাস্তায় যখন বাসার বাজার করার জন্যে বের হবেন, অদ্ভুত এক ভয়, মনে হবে আপনার মেরুদন্ড বেয়ে শীতল এক স্রোত নেমে যাচ্ছে। যদি আপনি মেয়ে হন, তাহলে এই ভয় আরো বেশি করে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবে সারা শরীরে। নিজেকেই প্রশ্ন করবেন, একটা সমাজ কি এভাবেই ভেঙে পড়ে, এত দ্রুত হবার কথা সবকিছু? বাড়ি ফিরে এইসব ভাবনা সব একপাশে রেখে আবার আপনি রান্না করে খেতে বসবেন।
শরীরে মেদ জমবে। অনলাইন ফিটনেস ট্রেনিং খোঁজা শুরু করবেন।
হাসা হবে প্রচুর। অনেক হাসবেন আপনি। চারপাশে হাসির এতোকিছু আছে, হাসতে হাসতে যে বিষম উঠতে পারে, হঠাৎ করেই তা আবিষ্কার করবেন। এমনকি আপনারা যারা রাম গড়ুরের ছানার মতো গম্ভীর মানুষ, সবকিছুতেই খুব সিরিয়াস, হঠাৎ করেই জীবন যে খুবই ঠুনকো, হালকা একটা ব্যাপার, মহাবিশ্বের তুলনায় খুবই অকিঞ্চিতকর, তা বুঝে যাবেন।
দেখা যাবে সুপারমার্কেট কিউ তে দেখা হবে বলে বন্ধু বা প্রেমিক/প্রেমিকার সাথে সময় ঠিক করে নেবেন, যাতে করে সামনে থেকে মানুষটাকে একটু দেখা যায়। ওর মাঝেও দেখা যাবে আপনি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নিয়ম মেনে চলছেন।
কি কি আপনার তেমন একটা দরকার নেই বা কোন জিনিষগুলো আসলে আপনার একেবারেই দরকার নেই, সেগুলো হিসেব করতে বসে যাবেন।
আপনার চারপাশের মানুষের সত্যিকারের চেহারাটা এই সময় একেবারে পরিস্কার ভাবে আপনার সামনে ভেসে উঠবে। আপনি একই সাথে মানুষ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে থাকবেন, বিস্ময়ের তো কোন সীমা পরিসীমাও থাকবেনা।
যাদেরকে সবসময়ই খবরে দেখে এসেছেন, এরা দেখবেন হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেছে, ওদের মতামত গুলোকেও মনে হবে অপ্রাসঙ্গিক। কেউ কেউ সবকিছুতেই খুব যুক্তির কচকচানি দিয়ে ভারী কথা বলার চেষ্টা করবেন, সেই কথায় সহমর্মীতা বলে কিছু থাকবেনা, এই লোকগুলোর কথাবার্তা দেখা যাবে আপনি শুনছেনই না। এতোদিন যাদেরকে উপেক্ষা করে এসেছেন, দেখা যাবে তাদের উপরেই ভরসা করা যাচ্ছে, বিনয়ী মানুষ, বাস্তবধর্মী এবং অবশ্যই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ।
মানব প্রজাতির চরম এই ক্রান্তিকালে পৃথিবী বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছে, নিজেকে সজীব করছে, এরকম মতবাদ নিয়ে অনেকেই আসবে আপনার দেখার চোখটা বড় করে দেবার জন্যে। কথাগুলো ভালো লাগলেও একটা সময় পর প্রচন্ড বিরক্ত লাগবেঃ ভালো কথা, পৃথিবী খুব ভালো করে শ্বাস নিচ্ছে, কার্বন ডাই অক্সাইড এর নির্গমণ কমে অর্ধেক হয়েছে, সবই ঠিক আছে, কিন্তু সামনের মাসের বিলগুলো কে দেবে?
পৃথিবীর এই আয়োজন করে নতুন ভাবে জন্ম নেয়ার সাক্ষী হওয়াটা খুব মহান কিছু, না খুবই ঝক্কির, এই নিয়ে নিজের ভেতর একরকম দোলাচল শুরু হবে।
নিজের বাড়ির জানালায় বা লন থেকে দেখা যাবে আপনি গান ছেড়ে দিয়ে শুনছেন। যখন আমরা আমাদের বেলকনি থেকে খুব জোরে ‘অপেরা’ ছেড়ে শুনতে শুরু করেছিলাম, আপনারাই ভেবেছিলেন, “শালার ইটালিয়ান গুলা…।” আমরা জানি আপনারাও ঠিক একই কাজটা করবেন, খুব উঁচু ভলিউমের কারনে জানালার কাঁচ প্রায় ভাঙি ভাঙি করছে, জানালার ওপাশে যখন কাউকে দেখবেন, আপনারা মাথা নড করবেন, একই কাজ উহানের লোকজন করেছিলো ফেব্রুয়ারীতে, এখন আমরা, এর পরেই আপনারা আছেন।
লকডাউনের পরই ‘সংসারের গুষ্টি কিলাই’, এরকম ভাবনা নিয়ে অনেকেই ঘুমুতে যাবেন প্রতিরাতে।
অনেক নারী গর্ভধারণ করবেন।
আপনার শিশু অনলাইনে স্কুলের ক্লাস করবে। সারাদিন বাড়িতে ভয়াবহ চিৎকার চেঁচামেচি, তাও দেখা যাবে আপনার খারাপ লাগছেনা, ভালোই লাগছে।
বাড়িতে বয়স্ক যারা আছে, তারা দেখা যাবে একরোখা, ঘাড়ত্যাড়া কিশোরদের মতো অবাধ্য আচরণ করছেন। বাড়ির বাইরে গেলে সংক্রমণের ঝুঁকি আছে, এবং একবার সংক্রমন হলে মরে যাবার সম্ভাবনা বেশি, এই কথাটা বোঝাতে আপনাকে মোটামুটি যুদ্ধ করতে হবে তাঁদের সাথে।
আইসিইউতে নিঃসঙ্গ এক শীতল মৃত্যুর কথা আপনি ভুলে থাকতে চাইবেন।
মনে হবে, এই মুহূর্তে স্বাস্থ্য খাতে যারা কাজ করছেন, তাদের যাওয়ার পথটায় ফুলের পাপড়ি ছিড়ে ছড়িয়ে রাখি।
আপনাকে বলা হবে, সমাজ আজ একতাবদ্ধ একটা গোষ্ঠীবদ্ধ প্রচেষ্টার কারনে। আপনি নিজেও সেই একতাবদ্ধ শক্তির মধ্যে, একই নৌকায় আছেন। এই অভিজ্ঞতাটা সারাজীবন আপনি নিজে যে বিশাল একটা সমাজের স্বতন্ত্র একটা অংশ হিসেবে দেখতেন, সেই দেখার চোখটা বদলে দেবে।
আমাদের সমাজে চালু যে একটা শ্রেণী ব্যবস্থা আছে, সেটাই বিশাল একটা পার্থক্য গড়ে দেবে। সুন্দর বাগান, লন আছে এরকম একটা বাড়িতে আটকে থাকা আর মানুষে গিজগিজ করা একটা হাউজিং প্রজেক্টে আটকে থাকা এক ব্যাপার না। ঘরে বসে অফিসের কাজ করতে থাকা আর নিজের চাকরিটা চলে যাচ্ছে দেখাটাও এক ব্যাপার না। মহামারী আটকাতে আমরা সবাই একতাবদ্ধ, একই নৌকার যাত্রী সবার কাছে এক মনে হবেনা। আসলেও ব্যাপারটা তো এক রকম না, কখনো এক ছিলোও না।
একটা পর্যায়ে বুঝতে পারবেন, কঠিন কাজটা খুবই কঠিন। আপনার ভয় লাগবে। আপনি তখন আপনার এই ভয় আপনার প্রিয় মানুষটির সাথে ভাগাভাগি করে নেবেন নয়তো চেপে রাখবেন নিজের মধ্যেই; যাতে আপনার প্রিয় মানুষটার উপরে কোন চাপ না পড়ে।
আপনি আবার খাওয়া শুরু করবেন।
আমরা ইটালীতে আছি এবং আপনার ভবিষ্যতে কি হতে যাচ্ছে তা আমরা এটুকুই জানি। খুবই অল্প মাত্রার ভবিষ্যৎ বলা, বলতে পারেন। আমরা স্রেফ দর্শক, তাও আবার বেশি দূর দেখতে পাইনা।
যদি একটু দূরে তাকাই, একটু সামনের পৃথিবীর দিকে, সেই পৃথিবী আমার আপনার দুজনের জন্যেই অজানা এক পৃথিবী হতে পারে সত্য, তবে একটা কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, এই সংকটের পর আমাদের এই চেনাজানা পৃথিবীটা আর আগের মতো থাকবে না।বদলে যাবে, অনেক বদলে যাবে।
অনুবাদঃ মানিক চন্দ্র দাস
সূত্রঃ দ্য গার্ডিয়ান