অধ্যাপক মো: রফিকুল ইসলাম এর কলাম থেকে …
আমাদের ইন্টার্নি সময়ে কেউ ইচ্ছে করলে যেকোন ‘মেজর’ বিষয়ে ৬ মাস একটানা ডিউটি করে সার্টিফিকেট নিতে পারতো।পরবর্তী কালে সেই সার্টিফিকেটের ফটোকপি দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন ভার্সিটিতে ‘মাগনা’ উচ্চশিক্ষার জন্য কতো যে চিঠি-পত্র লেখলাম, “ডিয়ার স্যার, আমি একজন গরীব দেশের মেধাবী ছাত্র…….দয়া করে একটা সুযোগ দিলে…..?” সব পত্রেরই উত্তর পেয়েছি(ওরা আসলেই ভদ্রলোক), “রিগ্রেট স্যার, সরি আমাদের ফান্ড নাই….।”
ইন্টার্নিতে পছন্দ হিসেবে আমি বেছে নিয়েছিলাম সার্জারি।মন-প্রাণ দিয়ে, হাতে-কলমে কাজটা শেখার চেষ্টা করছি।প্রফেসর, রেজিষ্ট্রার, সি এ, সতীর্থ, সবার সহযোগিতায় ভালোই শেখা হচ্ছে। ফোঁড়া কাটা, লাইপোমা, মুসলমানী তো ডাল ভাত, মাশাল্লাহ কয়েকটা এপেন্ডিসেক্টমি ও করে ফেলেছি।
আমাদের প্রফেসরের বাড়ি সিলেটে। নাম কবিরুদ্দিন আহমেদ।মেডিকেলে কোন ব্যাচে একই নামের একাধিক ব্যক্তি থাকলে সহজভাবে চেনার জন্য সতীর্থ’রা তাদের অদ্ভুত অদ্ভুত ‘নাম’ লাগিয়ে দেয়(ছাত্ররাও এই দুষ্টুমি করে)। এই ফর্মূলায় স্যারের নাম ছিলো “জেন্টেল কবির” স্যার।স্যারের আরেকটা সদগুণ (অথবা মুদ্রাদোষ) ছিলো তিনি সকলকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন। হাসপাতালের নতুন বিল্ডিং এর পেয়িং ওয়ার্ডে একজন ‘ইনডিরেক্ট ইংগুইনাল হার্নিয়া’র রোগী ভর্তি হলেন।ঐ বিছানাটার দায়িত্বে ছিলাম আমি।অপারেশান পূর্ববর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি দিয়ে তাকে সার্জারির জন্য তৈরী করছি।একদিন রোগীর এক আত্মীয়ের আচরণে ভীষণ মর্মাহত হলাম।ওদের বাড়ি সিলেটে। সিলেটি ভাষায় বলছে, “আমরা জেনেছি আপনার বাড়িও নাকি সিলেট।”
“জ্বী”। আমার সরল জবাব।
” আমাদের সৌভাগ্য স্যারের সাথে আরেকজন দেশী ডাক্তার পেয়ে গেলাম।”
“দেশী না হলেও আমাদের সেবা একই হবে।” আমি নির্লিপ্ত। অনেক ফালতু কথাবার্তার পরে লোকটা পকেট থেকে একটা ২০ টাকার নোট আমার হাতে ধরিয়ে দিতে চেষ্টা করলো।
“এটা কি?”
“আমাদের রোগীকে ‘একটু ভালো’ ভাবে দেখবেন।”
টাকাটা তাকে ফিরিয়ে দিলাম।রাগে, অপমানে জ্বলতে লাগলাম।(তখন সাধারণ ডাক্তারদের ‘ভিজিট ছিলো’ ৫০-১০০ টাকা।স্যাররা নিতেন ২০০-৩০০ টাকা)কম বয়সের বিচার-বিবেচনায় এটাকে ডাক্তারি পেশার অপমান মনে হলো।অপমানটা সহজে হজম করতে পারলাম না।সিস্টারকে আদেশ দিলাম এই রোগীর ফাইল ‘ক্লোজ’ করে দিতে।আমি ‘ডিসচার্জ লেটার’ লেখতে শুরু করলাম।
“স্যার আমাদের ভুল হয়ে গেছে।মাফ করে দেন।”
“এইতো ‘ভাল’ চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি।”
স্বদেশীদের প্রতি দুনিয়ার সব মানুষই একটু দুর্বল থাকে, থাকে সদয়।আমিও এর বাইরে ছিলাম না।আর এই দেশী অর্ধ-শিক্ষিত লোকটা কিনা আমাকে টাকা ‘ঘুষ’ দিয়ে অপমান করতে পারলো? আমার রাগের পারদ চড়তেই লাগলো।
‘ক্লোজড’ ফাইল গেলো সি, এ,’র কাছে।তিনি আমাকে আবেগের রাশ টেনে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে উপদেশ দিলেন।আমি নাছোড়বান্দা। শেষমেশ তিনি নিজে স্যারের কাছে ফাইল নিয়ে গেলেন।
“ভাই রফিক, দেখুন আপনারা এখন তরুণ! রক্ত গরম।জীবনে এর চেয়ে আরও অনেক বড় অনৈতিক, অন্যায় কর্ম চোখ বুঝে সহ্য করতে হবে ভাই। অবুঝ, বেয়াকুফ লোকজন।এরা অন্য অফিসে যেভাবে কাজ আদায়ের জন্য তদবির করে এখানেও তাই করেছে। আপনি ভাই এদের মাফ করে দেন। কাল ও,টি’র জন্য ‘রেডি’ করেন।” নীতিকথার ফাঁক-ফোকর নিয়ে স্যারের নাতিদীর্ঘ লেকচারেও আমার মনোকষ্ট দূরীভূত হলো না।
আমার অপমানের কারণটা কেউ বুঝলো না।দেবতূল্য ডাকতারদের ঘুষ সাধা! বন্ধু রিয়াজকে ঐ রোগীর ভার বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলাম নদীর কাছে। নদী আমার প্রেমিকার নাম নয়। বুড়িগংগা নদী, যার তীর ঘেঁষে আমাদের হাসপাতাল।কারণ গ্রামের ছেলে বলে আমি জানি জল আর জলের সোহাগ মাখা লিলুয়া বায়ূর পরশে সব জ্বালার হয় উপসম।
তবে আমার শেষ ভরসার আলোটা একেবারেই নিভে যায় নি।রিয়াজকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলাম।সে জানালো যে, অপারেশনটা করেছে সি,এ, হুজুর ফারুক ভাই।স্যার নিজে করেন নি। আমরা কানাঘুষো শুনতাম যে, শ্রদ্ধ্যেয় স্যাররা নাকি যারা চেম্বারে পকেট ভরে টাকা দেন শুধু তাদের রোগির দেহেই নিজের হাতে ছুরি চালান।
(সমাপ্ত)
লেখকঃ অধ্যাপক মো: রফিকুল ইসলাম, জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।
১৪/৬/১৭