মেঘনা নদীর তীরের অববাহিকায় অবস্থিত একটি জেলা চাঁদপুর। সেই জেলার একটি স্থানের নাম মতলব। প্রকৃতপক্ষে মতলব প্রশাসনিক দিক দিয়ে দুটো উপজেলায় বিভক্ত। মতলব উত্তর এবং মতলব দক্ষিণ। এই মতলবেই ১৯৬৬ সাল থেকে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) উন্নয়নশীল দেশে অন্যতম বৃহৎ এবং দীর্ঘ স্বাস্থ্য এবং জনমিতি সারভেইলেন্স প্রকল্প বা Health and Demographic Surveillance System (HDSS) চালিয়ে যাচ্ছে।
সেই ভাসমান বার্যঃ
আশ্চর্য এবং বিস্ময়কর বিষয় এই এই মতলব সেন্টারের শুরু হয়েছিল ষাটের দশকে একটি ভাসমান বার্য বা জলযান থেকে। এই মতলব ছিল কলেরাপ্রবণ একটি অঞ্চল। এই অঞ্চলে প্রায়ই কলেরা মহামারী দেখা যেত। প্রচুর মানুষ মারা যেত। পাকিস্তান আমলে জলাভূমির আধিক্য এবং রাস্তাঘাট উন্নত না থাকার জন্য এই বার্যে করে গ্রামে গ্রামে গিয়ে কলেরা রোগীদের সেবা দেওয়া হত।
সেই সময়ের কেউ ভাবতেই পারেন নাই যে সাবেক পাকিস্তান-সিয়াটো কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরির ভাম্রমান হাসপাতাল এই বার্য একদিন একটি পুরোদস্তুর স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং পৃথিবীর অন্যতম প্রসিদ্ধ একটি স্বাস্থ্য গবেষণাকেন্দ্রে পরিণত হবে।
আইসিডিডিআরবির এমিরেটাস বিজ্ঞানী ড মোহাম্মদ ইউনুস যিনি পাকিস্তান আমলে মতলবের এই সেন্টারে চিকিৎসক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন এবং সুদীর্ঘ ৪৭ বছর আইসিডিডিআরবির হয়ে কাজ করছেন , তিনি বলেন, “মতলব হাসপাতালে কলেরা রোগীর মৃত্যুহার ১% এর কম ছিল সবসময়। এটা প্রমাণ করে এই সেন্টারের সাফল্য।” ড মোহাম্মদ ইউনুস ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও মতলবের এই সেবাকেন্দ্র ছেড়ে যান নাই। তিনি দেখেছেন বার্য এবং সরকারের হেলথ কমপ্লেক্সের জন্য বরাদ্দকৃত ভবন থেকে কিভাবে মতলব আইসিডিডিআরবি সেন্টার একটি বিশাল কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
হাজার শিশুর জীবন বাঁচায়ঃ
নব্বইয়ের দশকে একটি বিজ্ঞাপন অনেক জনপ্রিয় ছিলঃ “ হাজার শিশুর জীবন বাঁচায়, এসএমসির ওরস্যালাইন।” মতলব সেন্টারের সূচনালগ্নে একটি বিখ্যাত এবং একই সাথে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ছিল গুড়, লবণ এবং পানি দিয়ে সহজে তৈরি করা ওরস্যালাইনের প্রথম ট্রায়াল। ১৯৬৮ সালে এই ট্রায়াল শুরু হয়। এতে অংশ নেন আমেরিকান গবেষক ডেভিড নালিন এবং রিচারড ক্যাশ। রিচারড ক্যাশ বর্তমানে হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং বাংলাদেশের ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথে দুটি কোর্স পড়ান। ল্যানসেট জার্নাল ওরস্যালাইনকে অভিহিত করেছে বিংশ শতাব্দীর সবথেকে বড় চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাফল্য হিসেবে। বলা হয়ে থাকে এই উদ্ভাবন সারা পৃথিবীতে ৫ কোটি লোকের প্রাণ রক্ষা করে প্রতি বছর।
৫ দশক ধরে অব্যাহত স্বাস্থ্য এবং জনমিতি সারভেইলেন্স প্রকল্পঃ
১৯৬৬ সালে মতলবে একটি স্বাস্থ্য এবং জনমিতি সারভেইলেন্স প্রকল্প চালু হয়। সেখানে কলেরা ভ্যাক্সিনের ট্রায়াল শুরু করার আগে জন্ম, মৃত্যু, অভিবাসন এইসব সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। পরবর্তীকালে এই প্রকল্প বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদের স্বাস্থ্যসমস্যা অনুধাবনে সহায়তা করে।
আরেক এমিরেটাস বিজ্ঞানী ড পিটার কিম স্ট্রিটফিল্ড, যিনি মতলবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন এবং ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মতলব স্বাস্থ্য এবং জনমিতি সারভেইলেন্স প্রকল্পের প্রধান ছিলেন তিনি বলেন জনস্বাস্থ্যভিত্তিক গবেষণায় নিখুঁত এবং যথার্থ তথ্য থাকা জরুরী। ছোট পরিসরে স্বাস্থ্য এবং জনমিতি সারভেইলেন্স প্রকল্প যে নিখুঁত তথ্য সংগ্রহ করছে, তা বিশাল পরিসরে ক্রুটিপূর্ণ তথ্য সংগ্রহের চেয়ে অনেক ভালো এবং কার্যকর। এটাই মতলব স্বাস্থ্য এবং জনমিতি সারভেইলেন্স প্রকল্পের মূলনীতি।
মতলবের এই তথ্য অনেক যুগান্তকারী গবেষণায় সাহায্য করেছে। নবজাতকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ধনুষ্টংকার ভ্যাক্সিন, কলেরা এবং রোটাভাইরাস ভায়ক্সিন, পরিবার পরিকল্পনা, শিশুদের ডায়রিয়ায় জিংকের ব্যবহার, বন্যার সময় পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ে গবেষণা এখান থেকেই শুরু হয়েছে।
২০০১ সালে মতলবের জনগোষ্ঠীর ওপর আর্সেনিকের প্রভাব দেখার জন্য আইসিডিডিআরবি আস-ম্যাট (As-Mat) নামক প্রকল্প হাতে নেয়। যা আর্সেনিকের মৃত্যুহার এবং সৃষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে অন্য বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করে।
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার প্রতিরোধে বিভিন্ন গবেষণা মতলবেই হয়েছে। বাংলাদেশে রোগতত্ত্বের যে পরিবর্তন ঘটছে অর্থাৎ সংক্রামক ব্যাধি থেকে অসংক্রামক ব্যাধির হার বেড়ে গিয়েছে তা জানা যায় মতলব থেকে। ১৯৮৬ থেকে ২০০৬ এর তথ্য বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান গবেষকরা। এই জন্য ব্যবহার করা হয় মতলবের তথ্য। পিটার কিম স্ট্রিটফিল্ডের নেতৃত্বে পরিচালিত এই গবেষণায় কারার জুনায়েদ আহসান এবং নুরুল আলম এই গবেষক দলের সদস্য ছিলেন।
মতলব হাসপাতালঃ
দক্ষিণ মতলব উপজেলায় অবস্থিত এই মতলব হাসপাতাল প্রতি বছর ৩০০০০ এর বেশি মানুষকে ডায়রিয়া, মাতৃ এবং শিশু স্বাস্থ্যের উপর সেবা দিয়ে থাকে। আইসিডিডিআরবির ঢাকা হাসপাতালের ডাক্তার এবং নার্সরা পালাক্রমে এই মতলব হাসপাতালে ডিউটি করেন। এর ফলে ঢাকার সাথে এর স্বাস্থ্যসেবার মানের সমতা বজায় থাকে।
মতলব সেন্টারের গর্ব তাদের মূল হাসপাতাল। একে বলা হয় আইসিডিডিআরবি মতলব হাসপাতাল। এখানে ডায়রিয়া, শ্বাসতন্ত্রের রোগব্যাধি, অপুষ্টি এবং মাতৃরোগের নানা চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরেঃ
মতলব হাসপাতালের কাছেই সুফিয়া খাতুনের বাসা। তাঁর বয়স সত্তরের বেশি। তিনি পাঁচ দশক ধরে এই মতলব সেন্টার থেকে সেবা নিচ্ছেন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। তাঁর চার প্রজন্ম এই হাসপাতাল থেকে উপকৃত হচ্ছেন।
শুধু সুফিয়া নন, আশেপাশের মানুষজন এই হাসপাতালের কাছে ঋণী।
সেই সব কর্মীঃ
আইসিডিডিআরবির বর্তমান নির্বাহী পরিচালক জন ক্লিমেন্স আশির দশকে তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন এই মতলব থেকেই। সেই বার্যেই তিনি কাজ করেছিলেন।
নুর ইসলাম গাজি মতলবে ৫০ বছর ধরে পাচকের কাজ করছেন। তার চাকুরীজীবন পাকিস্তান আমল, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশব্যাপী বিস্তৃত। তিনি বলেন, “আমার এখানে কাজ করতে ভালো লাগে। কখনও এই জায়গা ছেড়ে যেতে চাই না।”
তাজুল ইসলাম তিন দশক ধরে লন্ড্রি অপারেটর হিসেবে মতলব হাসপাতালে কাজ করেন। তিনি বলেন, “এখানে অসুস্থ রোগীর সেবায় আমিও খানিকটা অবদান রাখতে পারছি এই ভেবে ভালো লাগছে।”
মোহাম্মদ সেলিম কাজ করেন একজন স্পিডবোট ড্রাইভার হিসেবে। তিনি মতলবের দুর্গম গ্রামগুলো থেকে কলেরা রোগী নিয়ে আসতে সাহায্য করেন। এই নৌ অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের মাধ্যমেই প্রচুর রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে।
আবার ফিরে আসি সেই বার্যেঃ
এত কিছুর ভিতর মতলব হাসপাতাল প্রাঙ্গনে সেই বার্য এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীতে তৈরি এই বার্য অনেক ঘটনার সাক্ষী। এটি প্রথমে ছিল জলদস্যু, দক্ষিণের জলাভূমিতে যারা লুণ্ঠন করে বেড়াত তাদের ধরার পর ব্রিটিশ সরকারের সাময়িক বন্দীশালা। এই বার্যেই থাকতেন বিচারক, যিনি ভাম্রমান আদালতের কাজ পরিচালনা করতেন।
একশত বছর পর বার্যটি আবার কার্যকর করা হল। এবার এক দানবের হাত থেকে দক্ষিণের জলাভূমির গ্রামগুলোর মানুষকে বাঁচানোর জন্য। সেই দানবের নাম কলেরা।
আপনি যদি মতলব সেন্টারে ঘুরতে যান বার্যটি দেখতে ভুলবেন না যেন। এই যে বিশাল মতলব সেন্টার, আশেপাশের মানুষ বছরের পর বছর যার উপকারিতা ভোগ করে আসছে, বিশ্বের চিকিৎসাবিজ্ঞানের কিছু অভূতপূর্ব সাফল্য, তার শুরু হয়েছিল এই বার্য থেকেই।
তথ্যসূত্র এবং ছবিঃ
১। Matlab: Five decades of life-saving solutions, Muhammad Nabil, আইসিডিডিআরবি ওয়েবসাইট।
২। মতলব আইসিডিডিআরবি কেন্দ্রঃ স্বাস্থ্য গবেষণার এক পীঠস্থান, রজত দাশগুপ্ত, প্ল্যাটফর্ম ।
৩। আইসিডিডিআরবি ওয়েবসাইট।
৪। http://rehydrate.org/ors/ort-history.htm