যখন মেডিকেলে পড়তাম, অনেকেই আফসোস করতো … আহা রে! তোমাদের কত কত রোগের নাম মনে রাখতে হয়। কত ওষুধের নাম মনে রাখতে হয়! আচ্ছা, এমন হয় না যে, ভুলে অন্য ওষুধ দিয়ে দিয়েছ …?!
আসলে বলতে বাঁধা নেই, মেডিক্যালের পড়া অনেক বেশী, কিন্তু এতো জটিল না যেমন অনেকেই ভাবে। শতাব্দীর প্রাচীন কাল থেকে এই চিকিৎসা বিদ্যা চলে আসছে, বরং এটাই সবচেয়ে গুছানো বিদ্যা আমার মনে হয়। এখানে রোগের নাম- কার্যকারন শেখার একটা ধারাবাহিকতা আছে – যেন এলোমেলো না হয়। সবই মনে রাখা লাগে না, একটা ছকে ফেলা যায় অনেক কিছুই। একই ভাবে ওষুধের নাম গুলোও। শ্রেণী- উপ শ্রেণী- ধারা … অনেক রকমে ভাগ করে শেখানো হয়, যেন ডাক্তার নিজের নাম ভুলতে পারে, কিন্তু সে ওষুধের নাম ভুলবে না! তাই এক ওষুধের জায়গায় আরেক ওষুধ দেয়ার মতো ভুল হবার কোন অবকাশই নেই।
কি হবে যদি ‘ভুল ওষুধ’ দেয়া হয়!?
বেশির ভাগ জনগনের ধারনা, একেক রোগের ওষুধ সম্পূর্ণ একেক রকম। এবং একটার ওষুধ একটায় দিলেই, কেল্লা ফতে!! রোগীর মৃত্যু!!
ব্যাপারটা ৯৯.৯৯% ক্ষেত্রে তা নয় মোটেই। যেকোনো প্রেসক্রিপশন নিয়ে দেখেন, রোগ একটা হলেও মিনিমাম ৩/৪টা ওষুধ দিয়ে সেটা ভালো করা হয়। তারমানে একক একটিই ওষুধ দিলেই রোগটা সেরে যেত সেটা ভাবা যেমন ভুল ধারনা, তেমনি একক একটি ওষুধ ‘ভুল করে’ দেয়ার কারনেই রোগী মরে গেলো, সেটাও বিরাট ভুল ধারনা!
যে কোন ওষুধ গবেষণাগার থেকে মানবের উপর ব্যবহার হবার আগে বছরের পর বছর পরীক্ষা পেরিয়ে আসে। ওষুধটা কতটা কার্যকর, তা বিবেচনার চাইতেও বেশী সময় দেয়া হয় ওষুধটা অন্য রোগের জন্য কতটা বিপদজনক সেটা বিবেচনা করতে। একটা মানদণ্ড রাখা হয় এ ক্ষেত্রে, সেটা হলঃ ওই ওষুধটা কি পরিমান দিলে রোগ ভালো হবে, বনাম কি পরিমান দিলে বিষের মতো কাজ করবে সেটার তুলনা। ৯৯.৯৯% ক্ষেত্রে, অনেক অনেক অনেক বেশী পরিমানে দিলে বিষে পরিনত হয়, এমন ঔষধই গবেষনা থেকে চিকিৎসা বিদ্যায় উঠে আসে। তাই ভুল করে একটা ওষুধ খেয়ে ফেললে আমি- আপনি- ওরা কেউই মরে যাবো না!!
অনেক সময় পেপারে পড়েন, “ ভুল ইঞ্জেকশনে রোগীর মৃত্যু” … সেদিন মনে মনে একটু প্রশ্ন করবেন, এমন তো কোন সহজে পাওয়া যাওয়া ইঞ্জেকশন নেই, যেটা ‘ভুল করে দিলেও’ রোগীর সাথে সাথে মৃত্যু হবে। তাহলে নিশ্চয়ই রোগীটা ওই সময়ে এমনিতেই মারা যাচ্ছিলেন, ইনজেকশনটার জন্য নয়। কিন্তু বেশির ভাগ রোগীর লোক এই সহজ কথাটা মানতে চায় না। তারা ডাক্তারকে ডলা দিয়ে দেয় একটা!!
একটু ভাবলে কি হয়, রোগীটা ইচ্ছা করে মেরে ডাক্তার কি পাবেন?!!
-রোগীর জায়গা জমি? সহায় সম্পদ?! নাকি ‘পিতার হত্যার বদলা’ নিবেন?!!
নাকি ভাববেন, ডাক্তার গবেট?!
-আরে, বললাম তো, ডাক্তারি পড়ে আপনিও বলবেন, ডাক্তার নিজের নাম ভুলতে পারে, কিন্তু ওষুধের নাম ভুলবেনা!
নাকি ভাববেন, ‘ভুল ইঞ্জেকশন’ দিয়েছে?!
-বললাম তো, এমন ওষুধ দুনিয়ায় হাতে গোনা কয়েকটাই আছে। ৯৯.৯৯% ক্ষেত্রে এমন ভয়ঙ্কর ওষুধ হাতের কাছে, ফার্মেসীতে, ডাক্তারের ব্যাগে কোনদিনই পাবেন না। এগুলো ব্যবহারের নিয়ম আছে – সময় আছে – অবস্থা আছে।
পেপার খুললেই প্রতিদিন চিকিৎসক নিগ্রহের খবর শুনি। আজাইরা কাজে দৌড় মেরে বড় বড় পাঁচ তারা হাসপাতালে যেয়ে, গাদা গাদা টেস্ট করে, ফাইভ স্টার হোটেলের মতো থেকে – খেয়ে আপনারা পকেট ভরেছেন রাঘব- বোয়াল ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের; অথচ কসাই বলেন তাদের বেতন ভুক প্রফেসর ডাক্তারকে ; আর ‘ভুল চিকিৎসার’ ধুয়া তুলে মাইর দিয়ে মনের ঝাঁজ মেটান গ্রামে – গঞ্জে – শহরে – বন্দরে চুপচাপ জনসেবা করে যাওয়া নিরীহ ডাক্তারদের।
১ বছর উপজেলায় ডাক্তারি করেছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, নিজের অর্জিত জ্ঞান দিয়ে অনেক রুগীকে উপজেলাতেই ভালো করে ফেলতে পারতাম। কিন্তু আপনারা বুঝে- না বুঝে গায়ে হাত দিবেন – ডাক্তারের কলার চেপে ধরবেন, সে জন্য কিছু অলিখিত নিয়ম ছিল আমাদের।
১। বেশী বুঝে এমন আত্মীয়ওয়ালা রুগীকে হালকা চিকিৎসা দিয়ে দ্রুত জেলা হাসপাতালে রেফার করুন! জেলা হাসপাতালও তাদের মেডিক্যাল কলেজে রেফার করে। মেডিক্যাল কলেজ ঢাকায় পাঠিয়ে দেয় … কারন, কিছু একটা অনাকাঙ্খিত হলে, কে বুঝাবে এতো বুঝদার আবালদের!!
২। মরনাপন্ন রোগীকে কখনো শেষ চেষ্টা করবেন না। শেষ সময়ে কোন ইঞ্জেকশন দিয়ে – বুকের উপর চাপ দিয়ে হার্টকে সচল করে – এমনকি ভালো রুগীকেও ক্যাথেটার- ক্যানুলা করতেও সাবধান!! কারন রুগী হয়ত এমনিতেই মারা যাচ্ছেন, কিন্তু দোষ পরবে “ ওই ভুল ইঞ্জেকশনের!” “ওই যে ডাক্তার বুকে চাপাচাপি করলো তাই!” “ওই যে ক্যাথেতার দিল তাই!!”
৩। রোগী মরতে নিলে তাকে বিনা কারনে অক্সিজেন দিয়ে রাখুন ( এতে খুব উপকার হয় বলে রোগীর বিজ্ঞ আত্মীয় স্বজনের ধারনা!), বিনা দরকারে দুই তিন বার করে প্রেশার মাপুন ( মরার পথে রুগী এতে কষ্ট পেলেও কিছু করার নেই, কারন প্রেশার মাপাই এদেশে আসল যত্ন নেয়া!) এবং সবচেয়ে জরুরি, আগে ভাগেই বলে রাখুন রোগী বাঁচবে না!! ( কারন শেষমেশ বাঁচিয়ে দিলে সেটা আল্লাহ্র কুদরত অবশ্যই, কিন্তু মরে গেলে সেটা আল্লাহর কুদরত নয়! সেটা ডাক্তার কসাই এর কাজ! রোগী তো নাহয় ভালই ছিল!!)
… তো এভাবেই, আসল চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে বাধ্য হয়ে আমাদের আউফাউ কাজ করতে হত। অথচ জনসাধারণ একটু বুঝ ওয়ালা হলে আমরা আমাদের সবটা উজাড় করে দিতে পারতাম।
৬ বছর ধরে আমাদের শিখিয়েছে জমে টানাটানি করে কিভাবে মানুষকে জীবনে ফেরাতে হয় …
কিন্তু আফসোস, কেউ ডাক্তারদের বিশ্বাস করে না। বরং তাকেই জমের দুয়ারে পৌঁছে দেয়!! এতে কার কি লাভ হচ্ছে জানি না। আপনারা জানেন?!!
লিখেছেন: ডা. তাহসিনা আফরিন
এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি-আফ্রিকা উইং, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
রেডিয়েশন অনকোলজি (এমডি-পার্ট ২), জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনিস্টিটিউট ও হাসপাতাল
পরিমার্জনা: বনফুল