১২ এপ্রিল ২০২০:
“মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক। আপনাকে জানাই সালাম ও শ্রদ্ধা।
অত্যন্ত সম্মানের সাথে এবং বিনয়ের সাথে আপনার সদয় অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে কিছু তথ্য আপনার কাছে হয়ত বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেটা প্রমাণিত হয় ডাক্তারদের প্রতি আপনার সেদিনের অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশে। ডাক্তারদের শেষ ভরসার জায়গা থেকে অবিশ্বাস আর অসন্তোষ প্রকাশে ডাক্তারদের মনোবল ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে।
একটি মরণঘাতি এবং সাংঘাতিক ছোঁয়াচে রোগের চিকিৎসা কাছে থেকে দেয়া ভীষণ মানসিক চাপসম্পন্ন। আই সি ইউতে একটি মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচিয়ে রাখার চাপই অপরিসীম। তার সাথে যখন যোগ হয় নিজের বেঁচে থাকার চাপ সেই চাপ কত ভারি হতে পারে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সরকারী হাসপাতাল কিংবা বেসরকারী হাসপাতাল কিংবা চেম্বার (আনডায়াগনোজড ক্যারিয়ারের জন্য) সবক্ষেত্রেই কিছু চাপ থাকে। সমাজের কিছু মানুষের তীব্র নেতিবাচক সমালোচনাতেও মনের উপর চাপ পড়ে।
তাই এই দুঃসময়ে, মহা দুর্যোগে আপনি একমাত্র অভিভাবক যার অভয়বাণী আর উৎসাহ না পেলে তারা ভেঙ্গে পড়ে।
দু’টো বিষয়ের ব্যাখ্যা
১। প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ করে কেউ পালায় নি। চেম্বার বন্ধ সংক্রমণ ছড়ানো প্রতিরোধে সহায়তা করেছে। পেশেন্ট থেকে পেশেন্টে, পেশেন্ট থেকে ডাক্তারে এবং ডাক্তার থেকে অজস্র পেশেন্টে। অনেকের শুধু যে আয় বন্ধ, তা নয়, অনেকে খরচের বোঝা মাথায় নিয়ে চেম্বার বন্ধ রেখেছে। তাতে পেশেন্টদের স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে অসুবিধে হলেও এই দুর্যোগে আহামরি অসুবিধে হচ্ছে না। যখন যার দরকার টেলিফোন, ই মেইল, ওয়াটস এ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার বিভিন্ন মাধ্যমে কনসাল্ট্যান্সী নিচ্ছে। একজন চিকিৎসক ঘরে বসে যথাসম্ভব সাপোর্ট দিচ্ছেন। বুঝদার পেশেন্টরা নিজেরাই ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। যত কম বের হবে ততই মঙ্গল। চেম্বারে চিকিৎসা দেয়া হয় না, চিকিৎসাপত্র লেখা হয়। যেটা আমরা এখন বিভিন্নভাবে দিয়ে আসছি। বেশী অসুবিধে যার হবে সে ইমারজেন্সীতে আসবে।
তাই সব সরকারী, বেসরকারী হাসপাতালেও বহির্বিভাগ বন্ধ থাকা একান্ত বাঞ্চনীয়।
চিকিৎসক রিজার্ভ রাখারও একটি ব্যাপার আছে। সকলকে একসঙ্গে এক্সপোজড করলে চিকিৎসক সংকট হবার সম্ভাবনা আছে। কারণ কেউ অসুস্থ থাকবে, কেউ কোয়ারেন্টাইনে থাকবে। মিথ্যাবাদী কোভিড রোগীদের কারণে অনেক চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী অলরেডী কোয়ারেন্টাইনে। তাই বহির্বিভাগ বন্ধ এবং ইনডোরেও ভাগ করে রোস্টার করে ন্যূনতম চিকিৎসক দিয়ে চালানো জরুরী।
২। পেশেন্ট দ্বারে দ্বারে ঘুরে মৃত্যুবরণ করেছেন। ডাক্তারসমাজ সেজন্য যারপরনাই দুঃখিত।
কিন্তু এই দ্বারে দ্বারে ঘোরার জন্য দায়ী ব্যবস্থাপকগণ।
শুরু থেকে করোনা রোগীর চিকিৎসার ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় কিংবা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোন দিকনির্দেশনা ছিল না।
একটিমাত্র জায়গায় করোনা টেস্টকে কুক্ষিগত করে রাখার ফলে সন্দেহজনক কোভিড রোগী যখন যে হাসপাতালে গেছে তাদের টেস্টের সুবিধা ছিল না।
ডেজিগনেটেড হাসপাতাল পজিটিভ না হলে নিবে না কারণ সে নেগেটিভ হলে ওখানে ঢুকে ইনফেক্টেড হতে পারে।
অন্য হাসপাতাল পজিটিভ হলে নিবে না কারণ সে অন্য অনেক পেশেন্টদের ইনফেকটেড করতে পারে।
কি প্রাইভেট কি সরকারী, হাসপাতালগুলোতে তখন তো দূরের কথা এখনও সব জায়গায় কোন ট্রায়াজের ব্যবস্থা নেই। টেস্টিং এর ব্যবস্থা নেই। আইসোলেশনের ব্যবস্থা নেই। বিভিন্ন জোনে ভাগ করা নেই। তাহলে সন্দেহভাজন পেশেন্টকে কিভাবে ভর্তি করবে? এখনও বিভিন্ন জায়গায় কোভিড পেশেন্ট তথ্য গোপন করে ঢুকে যাচ্ছে অন্য পেশেন্টের মধ্যে। ফলাফল সব এক্সপোজড স্বাস্থ্যকর্মীর কোয়ারেন্টাইন।
ডাক্তার এবং পেশেন্ট উভয়েই এখানে এইসব অব্যবস্থাপনার শিকার।
ভাইরাসকে এয়ারপোর্ট দিয়ে অবাধে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই ভাইরাস এখন সারা দেশে। প্রতিরোধের মূল অস্ত্র ভেঙ্গে দিয়ে তার ভার বহন করতে হবে চিকিৎসককে।
আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা একটি বহুফাটলবিশিষ্ট ছেড়া প্যান্টের মত। সামনে জিপারটা একটু ভাল আছে বলে সামনের আব্রুটুকু রক্ষা পেয়েছে এতদিন। আর সেই জিপার হোল ডাক্তার। যে এতদিন কোনরকমে ঢেকে রেখেছে। এখন করোনার প্রলয়াঙ্কারী তান্ডবে আশপাশ, পিছন সব দেখা যাবে বলে শুধু দুর্ঘটনাই শুনতে হবে। জিপারকে আর দোষ দিয়েন না।
যেখানে টারশিয়ারী লেভেল হাসপাতালে আই সি ইউ নেই সেখানে ডাক্তারদের আর কি করার আছে। পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর নেই, থাকলেও বিকল। চালানোর মত পর্যাপ্ত এক্সপার্টও নেই।
স্বাস্থ্যকর্মীরা সবচেয়ে ভালনারেবল। আক্রান্তদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ডাক্তার। অলরেডি ২৯ জন আক্রান্ত তিনজন আই সি ইউতে। মারা গেছেন একজন হেলথ এসিস্ট্যান্ট।
গণমাধ্যমকর্মী, আইনশৃংখলা বাহিনী, স্বেচ্ছাসেবী এবং অন্যান্যদের সাথে স্বাস্থ্যকর্মীদের একটি বিরাট তফাৎ হল স্বাস্থ্যকর্মীরা ভাইরাসের ডিপোর মধ্যে থাকে, অন্যরা নয়। স্বাস্থ্য কর্মীদের রিপিটেড এক্সপোজারে ভাইরাল লোড অনেক অনেক বেশী থাকে। তাই এদের ঝুঁকির সাথে অন্য কারো ঝুঁকির তুলনা হবে না।
এ দেশের কিছু অবুঝ মানুষের অভিযোগ আর হলুদ সাংবাদিকদের ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে লেখায় ডাক্তার আজ ভিলেন। মন খারাপ হলেও কেউ পাত্তা না দিয়ে কাজ করে যায়।
কিন্তু তার নিজের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না থাকলে কাজ করবে কেমন করে? যথাযোগ্য পিপিই সকল করোনা রোগীর সেবকদের কাছে যাওয়া একান্ত বাঞ্চনীয়।
ডাক্তারদের অনেকেরই যাতায়াত থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। বাড়ীর লোকজনও এদের জন্য ঝুঁকিতে। এদের যাতায়াত, থাকা, খাওয়ার সুবিধাদি না দিলে সার্ভিস ব্যহত হতে বাধ্য।
সেই সুবিধা না দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রসাশনিক হেড করোনার চিকিৎসারত ডাক্তারদের তার বাসা থেকে দূরের রেস্ট হাউজে থাকতেও বাধা দিচ্ছে। সিলেট থেকে করোনায় আক্রান্ত ডাক্তার উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসতে চাইলে প্রশাসনের কোন সাহায্য পান নি। এই ডাক্তারদের সাপোর্ট না দিলে তারা কোথায় যাবে এবং রাষ্ট্রীয় কাজ করবে কিভাবে?
ডাক্তার না বাঁচলে কেউ বাঁচবে না।
ডাক্তারের নানানরকম খারাপী থাকতে পারে, কিন্তু রোগীর জীবনের জন্য যুদ্ধ করে না এমন কোন ডাক্তার নেই।
মাননীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, প্রশাসন থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত আমরা প্রস্তুত, আমরা প্রস্তুত বলে বলে ডাক্তার এবং জনগণের সাথে চরম প্রতারণা করে এসেছে এবং ডাক্তার ও জনগণকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
কাউকে বাঁচাবার সামর্থ না থাকলেও ডাক্তাররাই শেষ এবং একমাত্র রক্ষাকবচ। তাদের হুমকি ধামকি না দিয়ে একটু আপনার প্রার্থনায় রাখুন। কেউ সাজা পাবার মত কাজ করলে বিভাগীয় শাস্তির যে বিধান আছে সে পাবে। কারণ দর্শানো ছাড়া এই অস্থিতিশীল মুহূর্তে জনসম্মুখে চিকিৎসককে বরখাস্ত করা কতখানি যুক্তিযুক্ত ভেবে দেখতে হবে। এতে সকল চিকিৎসকের মানসিক চাপ বৃদ্ধি পেল কিনা সেটাও চিন্তার বিষয়। একজন দক্ষ ডাক্তার তৈরী হতে বহু সাধনা, বহু ত্যাগ আর বহু দিনের দরকার। ওদেরকে আমরা যেন মনে ও শরীরে বাঁচিয়ে রাখতে পারি।
তাই ভিতরের খবর জানার জন্য এবং পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার জন্য শুধু প্রশাসনের লোক নয়, প্রশাসনিক ডাক্তারও নয়, যারা রোগীর চিকিৎসা করে তাদের কথা দয়া করে শুনুন। ফ্রন্ট ফাইটারদের একমাত্র এবং শেষ ভরসা মাননীয় প্রধান মন্ত্রী। ডাক্তার রোগীকেও বাঁচাতে চায় নিজেও বাঁচতে চায়।
এই আপদকালীন সময়ের প্রচন্ড সমন্বয়হীনতায় আপনার হস্তক্ষেপে প্রলয় কমে যাবে নিশ্চয়।”
শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় নিবেদিত
আপনার একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক
অধ্যাপক রাশিদা বেগম
চীফ কনসাল্ট্যান্ট, আই,সি,আর,সি
ট্রেজারার, ও জি এস বি
বোর্ড মেম্বার, এশিয়া প্যাসিফিক ইনেশিয়েটিভ অব রিপ্রোডাকশন
মেম্বার, আমেরিকান সোসাইটি অব রিপ্রোডাক্টিভ মেডিসিন
মেম্বার, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফার্টিলিটি সোসাইটি
মেম্বার, ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব হিউম্যান রিপ্রোডাকশন এন্ড এম্ব্রায়োলজী
মেম্বার, ওয়ার্ল্ড এন্ডোমেট্রিওসিস সোসাইটি