পাবনা মানসিক হাসপাতাল এর মহিলা ওয়ার্ডের রোগীদের বক্তব্য সম্বলিত ইউটিউবে ভাইরাল হওয়া একটা ভিডিও এবং অনলাইন পোর্টালে বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ প্রচারের প্রেক্ষিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দেশের নবীন, প্রবীন মনোরোগ বিশেষজ্ঞগণ ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন বিভিন্ন শ্রেনী পেশার নাগরিকেরা।
গত ১১ ফেব্রুয়ারী “বাংলাদেশ টুডে” নামক অনলাইন পোর্টালে “ পাবনা পাগলা গারদে ভরছে সুস্থ নারীতে?” শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করা হয়। যেখানে ইউটিউবে প্রকাশিত একটি ভিডিওর লিংকসহ পাবনা মানসিক হাসপাতালে সেবার মান নিয়ে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচার করা হয়। এবং পত্রিকাটির সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য আইনের তোয়াক্কা না করে বেশকিছু শব্দের ব্যবহারও পরিলক্ষিত হয়।
সংবাদটি প্রচারের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেন দেশের বিভিন্ন স্থানের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা। তারা সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে এ ধরনের সংবাদ মাধ্যমের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। অনেকেই সস্তা জনপ্রিয়তার আশায় বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারের জন্য সংবাদ প্রকাশকের শাস্তি দাবি করেন।
মনের খবর ফেসবুকে আইডিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের কনসালটেন্ট ডা. এসএম আতিকুর রহমানের শেয়ার করা পোস্টে দেখা যায় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. চিরঞ্জীব বিশ্বাস মন্তব্য করেন-“যে যার মতো রিপোর্ট করছে। বাইপোলার বা সিজোফ্রেনিয়ার মতো বড় মানসিক রোগ চেনা সাধারণ সাংবাদিকদের পক্ষে কখনই সম্ভব না। কোন বড় মানসিক রোগে আক্রান্ত রোগীই নিজেকে অসুস্থ বুঝতে পারেন না। চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হবার পর তাদের আচরণ অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। তার সমস্যা মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ছাড়া কারো বোঝা সম্ভব না। সুতরাং সাংবাদিকদের সন্দেহ থাকলে আদালতের শরনাপন্ন হয়ে অভিযোগ করুক। প্রয়োজনে বোর্ড গঠন করে দেখা যাবে কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা।”
পাবনা মানসিক হাসপাতালের সহকারী রেজিষ্টার ডা. ওয়ালিউল হাসনাত সজীব তার শেয়ার করা পোস্টে লেখেন-“মানসিক রোগীর কথা শুনে রিপোর্ট???? মানসিক রোগী নিজেকে সুস্থই দাবী করে, এটা রিপোর্টার এর বোঝা উচিত ছিল। অবশ্য এটা তারা বুঝে রিপোর্ট করলে রিপোর্ট তো আর কেউ খাবে না!!!”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসিডেন্ট সজীব আবেদিন তার শেয়ার করা পোস্টে লেখেন-“পাগলে ভরে গেছে সাংবাদিকতা”।
অনলাইন পোর্টালটিতে সংবাদের সাথে ৪ মিনিট ৭ সেকেন্ডের একটি ভিডিও লিংকও জুড়ে দেওয়া হয়। যেটিকে নাসিরউদ্দিন সিলেট বিডি নামক ফেসবুক আইডি থেকে নেওয়া বলে উল্লেখ করা হয়। অনলাইনে খোঁজ করে দেখা যায় ৭ ফেব্রুয়ারী Bangali Tv নামক একটি ইউটিউব চ্যানেলে ১৬ মিনিট ১১ সেকেন্ডের একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়। যেখানে মানসিকভাবে অসুস্থ রোগীদেরকে গান গাইতেও দেখা যায়।
একটি রাষ্ট্রীয় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে এরকম সংবাদ প্রকাশের আগে সত্যতা যাচাইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলা উচিত ছিল কিনা?-মনের খবর এর পক্ষ থেকে বাংলাদেশে টুডে এর কাছে এরকম প্রশ্ন রেখে ফোন করা হলে তারা একঘন্টা পরে আবার ফোন করতে বললেও পরর্বতী সময়ে কেউ আর ফোন রিসিভ করেনি। তাই পত্রিকাটির মন্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
অনেকেই আবার এত লম্বা সময় ধরে হাসপাতালের রোগীদের ভিডিও কিভাবে করা হল সেবিষয়ে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকে দায়ী করেন। পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক ডা. তন্ময় প্রকাশ বিশ্বাস এই হাসপাতালে নিরাপত্তা রক্ষীর অভাব রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। এবং অনেক সময় ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের সুপারিশের কারণে হাসপাতালে দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষন্ত্রন পুরোপুরি সম্ভব হয় না বলে জানান তিনি। এদিন পাবনা মানসিক হাসপাতাল নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম কর্মীদের সর্তক থেকে দায়িত্বের সাথে সঠিক সংবাদ পরিবেশনের জন্যও অনুরোধ করেছিলেন হাসপাতালটির সহকারী রেজিষ্টার ডা. ওয়ালিউল হাসনাত সজীব।
বাংলাদেশ টুডে তে প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে জানতে চাইলে মানসিক স্বাস্থ্য সাংবাদিকতা বিষয়ে র্দীঘদিন ধরে কাজ করা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সালা্হ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব বলেন, “এখানে অনেকগুলো বিষয় জড়িত। প্রথমত, মানসিক রোগের চিকিৎসায় রোগীদের গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়। যারা ভিডিওটি প্রকাশ করেছেন তারা এটির লংঘন করেছেন। আর ভিডিওটি কিভাবে করা হল সেখানে হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্তদের জবাবদিহিতারও প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়াও যে সংবাদ মাধ্যমটি এবিষয়ে রিপোর্ট করেছে তারা তাদের শিরোনামে ‘পাগল’ শব্দটির ব্যবহার করেছে যেটি তাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করে। এবং তারা ওইসব রোগীদের সুস্থতা-অসুস্থতা নিয়ে মন্তব্য করেছেন যা একবারেই তাদের কান্ডজ্ঞানহীনতা।
সংবাদটি প্রকাশ করে সংবাদ মাধ্যমটি সাধারণ মানুষের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা বিষয়ে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে যা গোটা মানসিক স্বাস্থ্যসেবা খাতের প্রতি মানহানিকর বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক ডা. সালা্হ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পাবনা মানসিক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে দ্রুতই পরিচালকের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে একটি প্রতিবাদ লিপি পাঠানো হবে বলে জানানো হয়।
প্রতিবাদ লিপিটি হাতে পাওয়া মাত্রই মনের খবরে প্রকাশ করা হবে। এবং পাবনা মানসিক হাসপাতাল সম্পর্কে বিভ্রান্তি দূর করতে হাসপাতালের সঠিক চিত্র তুলে ধরে মনের খবরে দ্রুতই ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।
তথ্যসুত্রঃ মনের খবর