আমাদের দেশে থ্যালাসেমিয়া একটি মারাত্মক জেনেটিক/জন্মগত রক্তরোগ। স্বামী-স্ত্রী এ রোগের বাহক হলে তাদের সন্তান থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মাতে পারে। থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহকদের কোন লক্ষন থাকেনা। এরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করে। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের শরীরে রক্তের মূল্যবান উপাদান হিমোগ্লোবিন ঠিকমতো তৈরী হয়না। এই শিশুদেরকে অন্যের রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন থ্যালাসেমিয়া রোগের একমাত্র চিকিৎসা যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সব সময় সফল নয়। স্বামী এবং স্ত্রী দুজনই যদি থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হন তবে তাদের সন্তান থ্যালাসেমিয়া রোগী হিসাবে, থ্যালাসেমিয়া বাহক হিসাবে, বা সুস্থ্য সন্তান হিসাবে জন্মগ্রহন করতে পারে। তাই মাতৃজঠরে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে বাচ্চা থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত না সুস্থ্য তা নিশ্চিত হয়ে সন্তানের জন্মদান তাদের একমাত্র ভরসা।
মায়ের গর্ভে বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া রোগ নির্নয়ের যাবতীয় পরীক্ষা পদ্ধতি এখন দেশেই হচ্ছে। গর্ভবতী মাকে এজন্য আর বিদেশে যেতে হচ্ছেনা।
কিভাবে এই পরীক্ষা করা হয় ?
দুই ভাবে এই পরীক্ষা করা হয়। একটি এ্যামনিওসেনটেসিস (Amniocentesis) আর একটি করিওনিক ভিলাস স্যাম্পলিং (Chorionic Villus Sampling)
এ্যামনিওসেনটেসিস (Amniocentesis):
মায়ের গর্ভে বাচ্চা একটা ব্যাগভর্তি তরল পদার্থের মধ্যে অবস্থান করে। এই তরল পদার্থকে এ্যামনিওটিক ফ্লুইড বলা হয়। প্রথমে আল্ট্রাসনো মেসিনের সাহায্যে জরায়ুর ভিতরে বাচ্চা ও গর্ভফুলের অবস্থান নির্নয় করা হয়। আল্ট্রাসনো মেসিনের চলমান ছবি দেখে অত্যন্ত সুক্ষ একটি সুঁই বা নিডল মায়ের পেটের উপর দিয়ে বাচ্চার চারপাশের তরল পদার্থের ব্যাগের ভিতরে প্রবেশ করানো হয়। এবার সিরিঞ্জের সাহয্যে ১৫ থেকে ২০ মিলি তরল পদার্থ টেনে আনা হয়।
করিওনিক ভিলাস স্যাম্পলিং (Chorionic Villus Sampling):
মায়ের গর্ভে বাচ্চা গর্ভফুল (Placenta) এর মাধ্যমে মায়ের শরীর থেকে দরকারী পুস্টি পেয়ে থাকে। আল্ট্রাসনো মেসিনের চলমান ছবি দেখে সুঁই বা নিডল এর মাধ্যমে গর্ভফুল হতে সামান্য কিছু কোষকলা নিয়ে আসা হয়। এই পদ্ধতিকে করিওনিক ভিলাস স্যাম্পলিং বলে।
এই দুই পদ্ধতির মাধ্যমে সংগ্রহ করা তরল পদার্থ (Amniotic Fluid) বা গর্ভফুলের কোষকলা (Placental Tissue) ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয় ডিএনএ টেস্ট এর মাধ্যমে গর্ভের বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া রোগ আছে কিনা তা নির্নয়ের জন্য।
কখন এই পরীক্ষা করা হয় ?:
মায়ের গর্ভে বাচ্চার বয়স যখন ১১ হতে ১৪ সপ্তাহ তখন করিওনিক ভিলাস স্যাম্পলিং এবং ১৫ হতে ১৮ সপ্তাহ তখন এ্যামনিওসেনটেসিস পরীক্ষা করা হয়। এ সময় বাচ্চার আকার থাকে দেড়/ দুই ইঞ্চির মতো।
আলট্রাসনোগ্রাফী পরীক্ষা করে গর্ভে বাচ্চা ও গর্ভফুলের অবস্থান, বাচ্চার বয়স, জরায়ুর গঠন ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে চিকিৎসক নির্ধারন করবেন কখন এবং কোন পরীক্ষাটি গর্ভবতী মায়ের জন্য প্রযোজ্য।
এসব পরীক্ষা কি বেদনাদায়ক ?
এ সব পরীক্ষায় খুব সামান্য ব্যথা লাগে। একটা ইনজেকসন বা টিকা নিতে যেমন ব্যথা লাগে তেমন। তাছাড়া সুঁই ঢুকানোর জায়গাটি অনেক সময় অবস করে নেয়া হয় যাতে ব্যথা কম লাগে।
এসব পরীক্ষায় কোন ঝুঁকি আছে কি?
এ পরীক্ষাগুলো করার কারনে ১০০ হতে ২০০ জনের মধ্যে একজনের বাচ্চা নস্ট হতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে এটি সম্পূর্ন নির্ভর করে যিনি এই পরীক্ষাটি করবেন সেই চিকিৎসকের দক্ষতার উপর। খুবই বিরল ক্ষেত্রে যথেষ্ট নমুনা সংগ্রহ না হওয়ার কারনে পরীক্ষাটি পূনরায় করার প্রয়োজন হতে পারে।
পরীক্ষার পর সাবধানতা কী কী ?
পরীক্ষাটি সম্পন্ন করতে ১০ হতে ১৫ মিনিট সময় লাগে। পরীক্ষার পর ৩০ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে বাসায় যাওয়া যায়। কিছু এন্টিবায়োটিক ও প্যারাসিটামল জাতীয় ব্যথানাশক ওষুধ খেতে হয়। বাসায় গিয়ে দুই/তিন দিন ভারীকাজ ও দুরের ভ্রমন থেকে বিরত থাকতে হয়। মাসিকের রাস্তায় কোন প্রকার পানি জাতীয় স্রাব বা রক্ত গেলে সংগে সংগে চিকিৎসককে জানাতে হয়।
এসব পরীক্ষা কতটা নির্ভরযোগ্য ?
এই পরীক্ষার রিপোর্ট প্রায় শতভাগ নির্ভরযোগ্য। তবে মনে রাখতে হবে, যে রোগের কারনে পরীক্ষাটি করানো হচ্ছে অর্থাৎ থ্যালাসেমিয়া নির্নয়ের জন্য করা হলে কেবল বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া রোগ আছে কিনা তা বোঝা যাবে অন্য রোগ নয়। ভিন্ন ভিন্ন রোগের জন্য পরীক্ষাও ভিন্ন।
রিপোর্ট পেতে কত সময় লাগে ?
সাধারনত এক সপ্তাহের ভিতর পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া যায়। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
রিপোর্ট বা ফলাফল খারাপ হলে কী করনীয়
পরীক্ষার রিপোর্ট এ বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া রোগ ধরা পড়লে গর্ভবতী মাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি গর্ভাবস্থা চালিয়ে যাবেন কি না। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত সন্তান সংসারে আনতে না চাইলে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করতে হবে। পরবর্তী করনীয় সম্পর্কে চিকিৎসক মায়ের জন্য মঙ্গলজনক পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করবেন।
শেষ কথা:
সচেতনতার অভাবে আমাদের দেশে দিন দিন থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়ছে । দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় দশভাগ অর্থাৎ প্রায় দেড় কোটি পুরুষ-মহিলা নিজের অজান্তে থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক। কিন্ত একটু সচেতন হলেই আমরা এ থ্যালাসেমিয়া রোগ প্রতিরোধ করতে পারি। সাইপ্রাস, বাহরাইন, ইরান, সৌদি আরব, পাকিস্তান ইত্যাদির মতো পৃথিবীর অনেক দেশ বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীর বা বাচ্চা নেয়ার আগে স্বামী-স্ত্রীর থ্যালাসেমিয়া আছে কি না তা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক আইন করে থ্যালাসেমিয়া রোগকে নিয়ন্ত্রন করেছে। যে কেউ থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হতে পারে। যাদের বংশে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশু আছে তাদের ঝুঁকি বেশী । রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে সহজেই জানা যায় কেউ থ্যালাসেমিয়া বাহক কিনা। স্বামী এবং স্ত্রী দুজনে থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হলেই কেবল সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। একজন বাহক এবং অপরজন সুস্থ এমন দুজনের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হলে সন্তানদের কোন সমস্যা হবেনা। রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে ও আনুসাঙ্গিক খরচ বহন করতে গিয়ে আর্থিক দৈন্যতা ও মানসিক যন্ত্রনায় ভুগছে লাখো বাবা-মা। আমাদের দেশে থ্যালাসেমিয়া এখন এক নিরব মহামারী যাতে প্রতিবছর হাজার হাজার শিশুর মৃত্য হচ্ছে। ধংস হচ্ছে বাবা-মায়ের স্বপ্ন। সাধারন মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরী করার জন্য ৮ মে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস পালন করা হয়। দৈনন্দিন জীবনে আমরা ভালো থাকার জন্য কত না পরিকল্পনা করি। আসুন সুস্থ্য সন্তানের বাবা মা হওয়ার জন্য, মেধাদীপ্ত দেশ গড়ার জন্য, থ্যালাসেমিয়া রোগ সম্পর্কে সচেতন হই। মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে শিশুর জন্ম প্রতিরোধ করি।
লিখেছেনঃ
ডা. রেজাউল করিম কাজল
সহযোগী অধ্যাপক
প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়