প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০, বুধবার
লেখাঃ ডা. মুহাম্মদ শেখ সাদী
চট্টগ্রাম থেকে জরুরী প্রয়োজনে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে কোনো এক দুপুরে বিমানে ঢাকা যাচ্ছিলাম।
মাস্কাট থেকে আসা রিজেন্ট এয়ারওয়েজ এর একটা ফ্লাইট ছিল। চট্টগ্রাম এর যাত্রী নামিয়ে দিয়ে অল্প কিছু খালি আসনে ঢাকার কয়েকজন যাত্রী নিয়ে আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে ফ্লাই করল।
ফ্লাইট এ উঠে দেখলাম ওমান থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে আসা অধিকাংশই প্রবাসী যাত্রী, অধিকাংশের চোখে মুখেই ভ্রমণজনিত ক্লান্তি।
আমার সিটের অপর প্রান্তে দেখি টিয়া রং এর টিশার্ট পরা ২৫/২৬ বছরের একটা ছেলে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “ঢাকা পৌঁছাতে আর কতক্ষণ লাগবে?” এভাবে কথা শুরু হলো। জানলাম ও গত ৪ বছর ধরে ওমানে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করছে। এটাই ৪ বছর পর ওর প্রথম দেশে আসা।
এই ৪ বছরে লোন শোধ করা, বোনের বিয়ে করানো, বাবা-মার চিকিৎসা সব কিছুর খরচ যোগাতে গিয়ে আর দেশে আসতে পারেনি। ঢাকার আশেপাশের কোন এক গ্রামে তার বাড়ি।
ঢাকা বিমানবন্দরে ফ্লাইট ল্যান্ড করার পর যখন বিমান পুরোপুরি থামেনি এর আগেই দেখি ও সিটবেল্ট খুলে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আমি বলে আবার বসিয়ে দিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম ও এই রকম আনস্মার্ট কেন? বিমান পুরোপুরি থামার পর ও তাড়াতাড়ি আবার দরজার পাশে চলে গেল। বিমানবালা সবাইকে বসার অনুরোধ করে ডমেস্টিক যাত্রীদের আগে নামতে বলল। আমরা যারা চট্টগ্রাম থেকে উঠেছি তারা আগে নেমে গাড়িতে উঠে পড়লাম ডমেস্টিক এক্সিট এ যাওয়ার জন্য।
দেখলাম ওমান থেকে আগত যাত্রীরা সিঁড়ি দিয়ে নামছে, টিয়া রং এর টিশার্ট পরা ছেলেটা সবার সামনে আছে, যেন আগে নামলেই সে আগে বাড়ি পৌঁছে যাবে!
আবার ভাবছি সব কিছুতেই আমাদের তাড়াহুড়ো!!!
কিন্তু ওই ছেলেটা সিঁড়ির শেষ ধাপে এসে এমন একটা কাজ করল!!!
দেখলাম সিঁড়ির শেষ ধাপে এসে মাটিতে পা স্পর্শ করার আগে সে বসে পড়লো এবং দেশের মাটিকে সালাম করলো যেন ওর পা আগে মাটিতে না লাগে!!!
এই অসাধারণ ব্যপারটা এত দ্রুত ঘটে গেল কিছু বুঝার আগে, গাড়ি চলা শুরু করলো ইতোমধ্যে,
আমার মনের মধ্যে কেমন জানি মোচড় দিয়ে উঠল।
আনস্মার্ট ছেলেটি কাউকে শো-অফ করানোর জন্য না, দেশের প্রতি কতটানা ভালবাসা, শ্রদ্ধা ৪ বছর ধরে জমিয়ে রেখেছিল।
কি অসাধারণ অনুভূতি হৃদয়ে ধারণ করে রেখেছিল অতি স্বযত্নে সেই সাধারণ ছেলেটা!!
প্রবাস জীবনের শত কষ্টের মধ্যে থেকেও, দেশের সকল সুযোগ সুবিধা না পেয়েও, দেশের প্রতি এতটা ভালবাসা সে আগলে রেখেছে!!
আমরা দেশের আলো বাতাস ও এত সুযোগ সুবিধা পেয়েও কি দেশকে এতটুকুন ভালোবাসি?
ভাবতে ভাবতে সে সময় চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছিল।
আমরা যারা নিজেদের সব সময় স্মার্ট ভাবি, শো-অফ করি আসলে কি আমরা দেশকে অতটা ভালবাসি? যাদের কারণে দেশ সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, অর্থনীতি গতিশীল রয়েছে তাঁদের মতো করে?
দেশকে স্বাধীন করে এসে সেই দিন সেই লুংগী কাছামারা বীর মুক্তিযোদ্ধা তো এভাবেই চুপিচুপি দেশের মাটিকে সালাম করেছিল। দেশকে স্বাধীন করা সেইদিন এর সেই বীরদের এবং সেই স্বাধীন দেশকে গড়ে তোলার জন্য দিন- রাত খেটে যাওয়া দেশ ও দেশের বাইরে কর্মরত সকল পেশাজীবি-শ্রমজীবী বীরদের পক্ষ থেকে দেশ মাকে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম।
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি