মিটফোর্ড হাসপাতাল এবং ঢাকা মেডিকেল স্কুল(কলেজের) জন্ম কথা লিখছি ।
উইলের নয় নম্বর পয়েন্ট ছিলো-তাঁর ঘোড়াগুলোর মৃত্যুর পর সেগুলো পালনের জন্য যে অর্থ তিনি রেখে গেছেন GOVERNMENT OF BENGAL ঢাকাবাসীদের কল্যাণে তা ব্যয় করতে পারবে । ২১জুলাই,১৮৩৫-রবার্ট মিটফোর্ডের উইল । তিনি ঢাকা জেলার কালেক্টর এবং পরে প্রাদেশিক কোর্টের বিচারক ছিলেন ।
মিটফোর্ড বিকোয়েস্ট ফান্ড দিয়ে ঢাকার(পূর্ব বঙ্গের) সর্বপ্রথম সরকারী হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাব করেন গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি । উইলের টাকা নিয়ে অনেক নাটকের পর ৩২জন রোগী নিয়ে ১মে ১৮৫৮তে যাত্রা শুরু করে MITFORD NATIVE HOSPITAL । মিটফোর্ড হাসপাতালের আগে বাংলাদেশে(পূর্ববঙ্গে) চিকিৎসা বলতে ছিলো হাকিমী ও কবিরাজী চিকিৎসা । ১৮৩০ সালে ঢাকায় ছিল ৯ ঘর হাকিম এবং ৬৯ ঘর কবিরাজের বাস । যে জমিতে মিটফোর্ড হাসপাতাল স্থাপন করা হয় সে জমির মালিকদের দুজন ছিলো কবিরাজ ।
ডাঃ এলেক্স সিম্পসন হাসপাতালের ১ম ইউরোপিয়ান চিকিৎসক এবং সুপারিনটেন্ডেন্ট । এবং এই একজন ব্যক্তির জন্যে আমরা বাদামী চামড়ার মানুষজন গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে ও সাদা এপ্রন পরে PROUD DOCTOR আজ । এরকম কয়েকজন মানুষকে শ্রদ্ধা জানাতে এই লেখা ।
কলকাতা মেডিকেল কলেজের সব চেয়ে ভালো ছাত্র এই হাসপাতালের সাব-এসিট্যান্ট সার্জন পদে নিয়োগ পাবে । রোগী দেখার পাশাপাশি সেখানে একটি মেডিকেল স্কুল স্থাপনের জন্যে তাকে দায়িত্ব দেয়া হয় । হাসপাতালের ড্রেসাররা(ওয়ার্ড বয়)এ স্কুলের ছাত্র হবে । এদের মাঝে যারা ভালো করবে তাদের কলকাতা মেডিকেল কলেজে দেশীয় ডাক্তারী পড়ার জন্যে পাঠানো হবে ।(এই কেরাণী মানসিকতাই কিছুদিন আগে ডেন্টাল টেকনিশিয়ানদের বিডিএস ডাক্তারদের সমমানের সিস্টেম করেছিলো)
ঢাকার নবাব খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ এবং জমিদার কালী নারায়ণ রায়ের দানে হাসপাতালে প্রথম মহিলাদের জন্য ওয়ার্ড খোলা হয় । চিকিৎসা সুবিধা উন্নত থাকায় ঢাকায় বসবাসরত আর্মেনিয়, গ্রীক, ইংরেজ ও ইউরোপীয়রা এখানে টাকার বিনিময়ে চিকিৎসা নিতে আসে-এভাবেই পেয়িং বেডের শুরু । ১৯২০ সালে মিটফোর্ড সরকারীকরণ হয় । রোগীর চাপ অনেক বেড়ে গেলেও সে অনুযায়ী চিকিৎসক নিয়োগ সম্ভব না হওয়ায় তখন এক অভিনব ব্যবস্থা নেয়া হয়- অনারারি বা অবৈতনিক ডাক্তার নিয়োগ । সরকারী হাসপাতালে কাজ করার সুযোগ পেলে প্রাইভেট প্র্যাকটিস ভালো হয়-ডাক্তাররা এই নিয়োগ আনন্দের সাথে গ্রহণ করে ।(আজ ৯৩ বছর পরেও ডাক্তারদের আনন্দ কমেনা , ব্রিটিশরা কী মিষ্টি(অনারারি) খাওয়ায় গেলো মুখের মজা যায়না আমাদের । ওহ ভুলে গেছি ইহা একটি থ্যাঙ্কসগিভিং লেখা) ।
১৮৩৫ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হবার পর ঢাকা কলেজ(১৮৪১ EST)থেকে কিছু ছাত্রকে বৃত্তি দিয়ে সেখানে পড়তে পাঠানো হত । ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম পত্রিকা “ঢাকা প্রকাশ” বাংলাদেশে মেডিকেল স্কুল প্রতিষ্ঠার দাবী জানায় । ১৮৭৩ সালে লেফট্যানেন্ট গভর্নর স্যার জর্জ ক্যাম্পবেল ঢাকায় মেডিকেল স্কুল স্থাপনের প্রজ্ঞাপন জারি করেন । ১জুলাই ১৮৭৫ ঢাকা মেডিকেল স্কুল যাত্রা শুরু করে । THE BENGAL THEATRE এর হল রুমে মাটির মেঝেতে বসে ৩৮৪ জন ছাত্র পায় ডাক্তারি বিদ্যার প্রথম পাঠ । কারণ কর্তৃপক্ষ ৫০জন ছাত্রও হবেনা ভেবে প্রাথমিকভাবে ৫০জন ছাত্রের জন্য ক্লাস রুমের ব্যবস্থা করেছিলো । তিন বছরের কোর্স সার্টিফিকেটে লেখা থাকে-LICENSED TO PRACTICE MEDICINE(LMS) যা ১৯১৬ সালে LICENTIATE OF STATE MEDICINE FACULTY OFBENGAL(LMF) ডিগ্রীতে পরিণত হয় । পাশকরারা HOSPITAL ASSISSTANT হিসেবে পরিচিত হয় ।
SIR ALFRED W CROFT এর অনেক লড়াইয়ের পর ১৮৯৪ সালে ১ম মেয়েরা মেডিকেলে পড়তে আসে এবং ১৯১০ সালে ১ম সার্টিফিকেট পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হয় তিনজন । তাদের মাঝে একজন বাঙ্গালী-আলিকান্নেসা খাতুন । মেডিকেল স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের তিন বার কলকাতায় গিয়ে সার্টিফিকেট পরীক্ষায় অংশ নিতে হত । মূলত এই অমানবিক নিয়মের কারণে ১৯৩৮ সালে ঢাকা মেডিকেল স্কুলকে কলেজে রূপান্তরের দাবী উঠে । মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্যে একজন ছাত্রের বিপরীতে হাসপাতালে ৫টি শয্যা থাকতে হয় । মিটফোর্ড হাসপাতালে তখন ২৫১ বেড এবং সর্বোচ্চ ৩৭৪ বেডে উন্নীত করা যাবে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অর্থনৈতিক মন্দা , সার্টফিকেটধারী মেডিকেল এসিস্ট্যান্টদের প্রবল বিরোধীতা মেডিকেল কলেজ স্থাপনে বাঁধা সৃষ্টি করে । ঢাকার নওয়াবপুরের ধনাঢ্য ব্যক্তি জগমোহন পাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সংশ্লিষ্ট করে একটি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্যে ৪ লাখ টাকা দান করেন । তখনকার উপাচার্য ডঃ রমেশ চন্দ্র মজুমদার একক প্রচেষ্টায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী , স্বাস্থ্যসচিব , সার্জন জেনারেল , বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সকলের সম্মতি আদায় করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল ফ্যাকাল্টি হিসেবে মেডিকেল কলেজ স্থাপনের । ১৯৪৩ সালের ৩ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর রাইটার্স বিল্ডিংএর কক্ষে এক কনফারেন্সে ঢাকা মেডিকেল স্কুলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে রূপান্তরের ঘোষণা দেয়া হয় । মিটফোর্ড হাসপাতালের স্থলে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পুরাতন সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংটিকে ৫০০ শয্যার হাসপাতালে রূপান্তরিত করে এর আশেপাশে ঢাকা মেডিকেল কলেজ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় । ঢাকা মেডিকেল স্কুলের সুপারিনটেন্ডেন্ট এ ঢাকার সিভিল সার্জন ডাঃ জে ভার্জিন ঢাকা মেডিকেলের প্রথম অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া হয় ১জুলাই ১৯৪৬ ।
তবে ঢাকা মেডিকেল স্কুলটির শিক্ষাকার্যক্রম আগের মতই চলতে থাকে পূর্বের ক্যাম্পাসে এবং ১৯৬২ সালে এমবিবিএস কোর্স চালুর জন্যে স্কুলটিকে কলেজে রূপান্তরিত করা হয় । নামকরণ করা হয় মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ, ১৯৬৩ সালে গভর্নর আব্দুল মোনেম খান নাম বদলে রাখেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ । ২০০৮সালের ১মে মিটফোর্ড হাসপাতাল ১৫০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন করে ।
(আমাদের বাংলাদেশ এক দিনে গড়ে উঠেনি । কয়েকজন মানুষের জন্য এর অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারেনা ।
তথ্যসূত্র- মিটফোর্ড হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল স্কুল, ইতিহাস ও ঐতিহ্য ১৮৫৮-১৯৪৭ , অধ্যাপক শরীফ উদ্দিন আহমেদ , একাডেমিক প্রেস এন্ড পাবলিশার্স লাইব্রেরি ,ঢাকা , ২০০৭ ।
এবং অন্তর্জাল )
প্রথম ছবিটা সেই ১৮৫৮ এর হাসপাতাল এবং দ্বিতীয়টা ১৮৭৫’র মেডিকেল স্কুল ।
…
ডা.মোহিব নীরব