প্ল্যাটফর্ম নিউজ, রবিবার, ১৭ মে, ২০২০
খবর পেয়ে হাতের কাজগুলো সেরে যাবো ভাবলাম। মনে বাজতে থাকলো দেরী করছি না তো! নাহ্ এখনই যাই। কিছু পারিবারিক কাজ রেখেই গেলাম।
মুখে মাস্ক নিয়ে আমিও সাধারণ দর্শনার্থী, তিন তিনটা গেট থেকে বিতাড়িত হলাম। ডিউটিতে নতুন মুখ, আমিও মাস্ক পড়া, পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না। আমারই হাসপাতালে আমাকে ঢুকতে বেশ ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হলো। মনের মধ্যে মীর মাহবুব স্যার, কোথাও কোন গেঞ্জাম না করে, ২ মিনিটের পথ দশ মিনিটে পারি দিলাম। অতঃপর স্যারের সামনে।
– স্যার আমি স্বাধীন।
– নাহ্ কিচ্ছু হবে নানে, ভালোই আছি।
কোন অনুমতি ছাড়াই স্যারের হাত ধরলাম (জীবনে প্রথম), স্যারও হাত বাড়িয়ে দিলেন। পালস্ দেখলাম।
– স্যার, রেট, রিদম, ভ্যলুউম সব ঠিক আছে।
– তাতো আছেই!
– স্যার, অস্ট্রেলিয়া জানাইছেন?
(স্যারের দুই মেয়ে’র এক জন অস্ট্রেলিয়া থাকেন)
ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ঐ যে, মোবাইলে যোগাযোগ আছে, সারাক্ষণই। তুমি এক্সরেটা নাও”
ডানপাশের ডেস্ক থেকে এক্সরে টা নিলাম (ফাঁকে দেখে নিলাম Saturation 89-90% !)
স্যার এবং আমি দুজনেই দেখছি (Haziness with numerous consolidation occupying whole Rt. lung and middle and lower zones of Lt. lung)।
স্যারকে বললাম,
“স্যার ভালোই আছে, সবগুলো angel clear, কোন কালেকশন নাই, একটু hazziness আছে। কি জন্যে যে এটা হইছে!”
মনে হলো স্যার আশান্বিত হলেন, বললেন,
“একটু আগে আবার এক্সরে করা হইছে, ঐটা আসুক।”
চোখের দিকে চেয়ে দেখলাম Icteric (জন্ডিস)। জিজ্ঞেস করলাম,
– স্যার ট্রান্সপ্লান্টেশন এর কি..
স্যার নিজেই শুরু করলেন,
– করোনার জন্য পিছানো হইছে।
(মাদ্রাজে স্যারের লিভার ট্রাম্সপ্লানটেশন হওয়ার কথা, Cirhosis both lobe, আমি আগে ছবি দেখেছি, Neuremous nodule, both lobe)।
আমি Saturation এর দিকে তাকিয়ে রইলাম..
স্যার বুঝে গেলেন, বললেন,
– কত আছে? (মনিটর স্যারের পিছনে)।
– বললাম ৯২ (আছে ৮৮)।
– saturation টা একটু কম আছে।
– জ্বি স্যার, মনে হয় মেশিন বা wire connection এ কোথাও সমস্যা আছে, আমি উনাদেরকে একটু ডাকি।
– দেখো..
Supporting staff, doctor, nurse সবাই পরিচিত, একটু আসার জন্য বললাম।
(সবার প্রোটেকশন দেখে, নিজের দিকে তাকালাম। মনে মনে ভাবলাম, “কোভিড” দিয়ে মীর মাহবুব স্যার মরতে পারলে, আমিও মরতে পারবো।)
খানিকটা অনিহা নিয়েই, কানেকশন গুলো একটু নাড়া ছাড়া করা হলো, যা তাই saturation বাড়লো না।
স্যার বললেন,
– তুমি, এক কাজ করো, এক্সরে দুইটা নিয়ে আসো।”
– স্যার, আমি এক্সরে দুইটা নিয়ে আসবো, তবে এখন তো অফ আওয়ার, এদিক ওদিক লাগানো সব, আমি নিয়ে আসতেছি একটু দেরী হতে পারে।
– ঠিক আছে, যাও।
মিনিট ১০ এর মধ্যেই ফিরে এলাম, এসে দেখি স্যার ঘুমে। আমি বায়েজিদ বেশে দাঁড়িয়ে রইলাম…
মিনিট দুয়েক পর স্যার তাকালেন,
– আনছো!
– জ্বি স্যার।
– আনো দেখি।
দুজনেই দেখলাম কোন পরিবর্তন নাই। স্যার বললেন, ক্যানসার না তো!
সাহস পেয়ে বললাম,
“না স্যার, ঐ রকম Consolidation নাই। স্যার, আপনাকে বলি নাই, টিবি হইতে পারে।”
– হুম, টিবি মনে হয়।
– স্যার টিবি হইলে সমস্যা নাই, ১৫ দিন ঔষধ খাইলেই কন্ট্রোল।
স্যার, আমার দিকে চেয়ে হাসলেন…(হয়তো মনে মনে বললেন, আমারে শান্ত্বনা দাও!)
আমার দিকে তাকানো অবস্থায় ঐ মনে হলো স্যারের চোখ ভিজে আসছে, হাত দিয়ে চোখ মুছলেন। এর মধ্যে অনেকগুলো রিপোর্ট আসলো। বাইরে থেকে আমাকে একজন ডাকলেন। রিপোর্ট গুলোর ছবি তুলে পাঠাতে হবে ডিসিশনের জন্য। উনাদের হাতে গ্লাভস থাকায় কারো মোবাইলে ভাল কাজ করছে না। আমার মোবাইল দিয়ে ছবি তুলে অন্য মোবাইলে দিলাম। রিপোর্ট সবগুলোই স্বাভাবিক শুধু D-Dimer অনেক বেশি আর এক্সরে ..
স্যারের সামনে আসলাম, ম্যাডাম একজন চিকিৎসকের সাথে কথা বলতেছিলেন..
– স্যার জানতে চাইলেন, “কি বললো?”
– ম্যাডাম বললেন, “কিছু বলে নাই।”
মনে হলো স্যার কিছুটা অতৃপ্ত..
বললেন, “ডিসিশন দিবে না তো, আমাকে ধরিয়ে দাও।”
এটেনডেন্ট এর মাধ্যমে কল দিয়ে মোবাইল টা স্যারের কাছে দেয়া হলো… স্যার হ্যালো হ্যালো বলছেন..
আমাকে আবার বাহির থেকে ডাকা হলো… একজন জানালেন,
“যদিও স্যার কোভিড নেগেটিভ, আমরা হাইলি সাসপেক্ট করছি ..মানুষ কম থাকাই ভালো, আপনিও চলে যান।”
মনে মনে বললাম, আমি কোভিডের ভয় পাইনা। স্যারের অনেকগুলো comorbidities আছে, লিভার ফেইলর, ডায়াবেটিস, এখন রেসপিরেটরি ডিস্ট্রেস, X-ray abnormal, এতগুলো ঔষধ, স্যার cope up করতে পারবেন তো! এত শক্তিশালী মস্তিষ্ক কি থেমে যাবে! ভিতরে এসে স্যারকে বললাম,
“স্যার, আপনি রেস্ট নিন, রেস্টে থাকলে Saturation টা বাড়বে।”
– তাইলে তুমি যাও।
ম্যাডাম ও এটেনডেন্টকে আমার মোবাইল নাম্বার এনশিওর করলাম, যেকোন সময় ফোন দিবেন, আমি ধরতে না পারলে এসএমএস দিবেন, আমি চলে আসবো..
বাসায় ফিরেই জানলাম, স্যারকে লাইফ সাপোর্টে দেয়া হয়েছে..
অতঃপর কাউকে আর স্যারের প্রয়োজন হয়নি। স্যার, এখন ওপারে! মৃত্যু যে চরম সত্য! একটি যুগের সমাপ্তি। ওপারে ভাল থাকবেন স্যার!
লেখকঃ ডাঃ স্বাধীন