৩ নভেম্বর,২০১৯
চেম্বার যেহেতু করি এবং কিছু কিছু কোর্স যেহেতু করেছি তাই নামের সাথে ওগুলিও যোগ করে দেই।
যার ফলস্বরূপ রোগী যদি গাইনী বা মেডিসিনের হয় অথবা শুধু আল্ট্রা করতে আসে তারপরও মাঝে মধ্যেই বলেন ” ম্যাম ফর্সা হওয়ার একটা ক্রীমের নাম বলুন প্লিজ”। নামের সাথে ঐ কোর্স “ডিওসি(চর্ম)” যোগ করার এই হলো ফল।
আমি বলিঃ প্রথমত আমিতো ডার্মাটোলজিস্ট না, হ্যা, ডার্মা এর উপর ছোট্ট একটা কোর্স করা ব্যস।
দ্বিতীয়ত, ত্বক ফর্সা করার কোনো ক্রীম নাই।
তৃতীয়ত, যদি এমন ক্রীম থাকতো তাহলে আমি নিজেই ফর্সা হতাম আগে।
এবার শুনুন রোগীর বক্তব্যঃ
➡ বেটনোভেট বা বেটনোভেট-সি মাখলে তো ফর্সা হয় শুনছি। এইটাতো মেডিকেলের ঔষধ। এটা মাখা কি ঠিক??
➡ ম্যাম “নাইট ক্রীম” ব্যবহার করলে কি রং ফর্সা হবে? ওটা মাখলে শুনছি যতদিন ব্যবহার করা হয় ততদিন ফর্সা তারপর বন্ধ করলে আাবার আগের মতো নাকি হয়ে যায়??
➡ ফেসিয়াল, ব্লিজ কত বছর থেকে করা ভালো, এগুলোর কি সাইড ইফেক্ট আছে?
➡ আমার আত্মীয়রা বলেন তুমি তাহলে স্কীনের কি কোর্স করলে যে ফর্সা হওয়ার ঔষধের নাম জানো না!
ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি………
এবার কিছু ঘটনা বলিঃ
আমার আম্মু ফর্সার পাগল। নিজে ফর্সা প্লাস তার ভাইবোন, স্বামী, ছেলের বউ সবাই ফর্সা শুধুমাত্র তার ছেলেমেয়ে বাদে। ছোটবেলায় আমার মা আরো বেশী ফর্সা হতে চুন মেখেছিলেন। তারপর কি হয়েছিল তা আর নাই বললাম, বুঝে নিন।
এক রোগী এসেছিলেন মুখের মাঝে মাঝে কালো ছোপ ছোপ, আবার রেডিসও। কি হয়েছে? “বাসায় ব্লিজ করছিলাম, বেশি গ্লোডেন দেখানোর জন্য ব্লিজ পাউডারের পরিমান বেশি করে দিয়েছিলাম আর অনেকক্ষণ রাখার পর মুখ এমন হয়ে গেছে “। আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন ব্যাপারটা কি??
কেউ কেউ আসেন নাইট ক্রীম লাগায়ে (নাম মনে করতে পারছিনা ক্রীমগুলোর)। এগুলো লাগানোর ফলে মুখ ফ্যাকাসে সাদা হয়ে যায় সাথে চিক এরিয়াটা লাল হয়ে যায়। পুরা চেহারায় চেন্জ।
কেউ আবার বেটনোভেট লাগায়। তাতে নাকি ফর্সা হওয়া যায়। কিন্তুু এতে সমস্যা নাকি বন্ধ করে দিলে কালোভাব বেশি হয়ে যায় এবং স্কীন গ্লো নস্ট হয়ে যায়। তারপরও রোগীর ভাষ্য মাত্র ৩০টাকা দাম সমস্যা কি বন্ধ করবোনা ব্যবহার করা।
এরপর তো পার্লারে আছে বিভিন্ন ফেসিয়াল।
ঘরোয়া উপটান, উপকরনতো আছেই রুপচর্চার। আমার এক সিস্টার শসার রস মুখে চোখে লাগিয়ে এই যে শুয়ে ছিলো তারপর ঘুম, তারপর ঘুম থেকে উঠে দেখে চোখ খুলতে পারছেনা, রস চোখে গিয়েছে চোখ ফুলে ফেঁপে একশেষ। শেষে ৫দিন পর অফিসে আসে।
🍀 ত্বক সম্পর্কে কিছু কথা বলি
“ত্বক” হলো শরীরের সবচেয়ে বড় অঙ্গ। বাহিরের প্রতিকুল পরিবেশ থেকে ত্বক আমাদের শরীরকে রক্ষা করে।
🍀 ত্বকের কোষসমুহ
——————————–
১। কেরাটিনোসাইট কোষ
২। মেলানোসাইট কোষ
৩। ল্যাংগারহেনস কোষ
৪। মার্কেল কোষ
মেলানোসাইট এমন একটি কোষ যা আমাদের ত্বকের রং নির্ধারন করে। এই মেলানোসাইট “মেলানিন” নামক এক ধরনের উপাদান তৈরী করে।
ত্বকের রং নির্ভর করে এই মেলানিন কার শরীরে কতটা/ কি পরিমানে আছে তার উপর।
ত্বক কালো/ ডার্ক হওয়ার কারন অতিরিক্ত মেলানিন থাকার জন্য। মেলানোসাইট কোষ সবার শরীরে সমান পরিমানে থাকলেও মেলানিন কিন্তুু একেক জনের শরীরে একেক রকম থাকে। যার মেলানিন নিঃসরণ বেশি হয় তার ত্বকের রং কালো হয়ে হয়ে থাকে।
এখন তাহলে ভাবুন এইসব ক্রীম, ব্লিজ, ফেসিয়াল, শসা, পাউডার ইত্যাদী এগুলো কি মেলানিনের প্রোডাকশন বাড়াতে বা কমাতে পারবে??
না জেনে মানুষ কতকিছুই ব্যবহার করছে ফর্সা হওয়ার জন্য।
আমাদের উচিৎ ঐসব উল্টোপাল্টা জিনিস ব্যবহার না করা, স্কীনকে নস্ট না করা।
🍀 তাহলে আমাদের করণীয় কি?
➡ ফর্সাই সব না,
➡স্কীনের প্রতিদিন যত্ন নিন
➡ রোদে বের হলে সানস্ক্রিন /সানব্লক ক্রীম ব্যবহার করুন, ছাতা ব্যবহার করুন।
➡ যে সে ত্বক ফর্সাকারী ক্রীম ব্যবহার করবেন না।
➡ বাইরে থেকে এসে ফেশওয়াস দিয়ে মুখ পরিস্কার করুন।
➡ তৈলাক্ত ত্বক সবসময় পরিস্কার রাখুন কারন এই ত্বকে ময়লা বেশি জমে। প্রয়োজনে ওয়েট টিস্যু দিয়ে মুখ মুছুন।
➡ সপ্তাহে ১বার অন্তত স্ক্রাবার ব্যবহার করুন। এতে ডেডসেল দুর হবে। স্কীন পরিস্কার হবে।
➡ কোথাও বেড়াতে গেলে বাসায় এসে অবশ্যই আগে মুখ ভালো করে পরিস্কার করবেন তারপর অন্যকাজ।
➡ মুখে যেন ওপেন পোরস না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন।
➡ ব্ল্যাক হেডস, হোয়াইট হেডস পরিস্কার করুন।
➡ প্রচুর পরিমান, পানি, সবজি, ফল খান যা ত্বককে ভিতর থেকে হাইড্রেট করবে। সজীব ও প্রানবন্ত লাগবে।
➡ ভাজাপোড়া, তৈলাক্ত খাবার, অতিরিক্ত ফার্স্টফুড, মশলাজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন।
➡ মাথার ত্বক পরিস্কার রাখুন। প্রতিদিন গোসল করুন।
➡ পায়ের চামড়া একটু মোটা ও খসখসে হয়ে থাকে, সুতরাং বাইরে থেকে এসে পা কিছুটা গরম পানি+শ্যাম্পু/সাবান মিশিয়ে ভিজিয়ে রাখুন, তারপর পিউমিস স্টোন/ব্রাশ দিয়ে ঘষে পরিস্কার করুন।
তারপর মুছে নারকেল তেল/গ্লিসারিন /ভেসলিন লাগান পা নরম রাখতে।
➡ অতিরিক্ত পারফিউম /বডি স্প্রে অথবা কড়া সুগন্ধি ব্যবহার করা ঠিক নয়। এবং এগুলো সরাসরি স্কীনে ব্যবহার না করে পোশাকে করা ভালো। কন্টাক্ট ডার্মাটাইটিসের সম্ভবনা।
➡ যারা গোসলের আগে তেল মাখেন তাদের জন্য উপদেশঃ তেল কখনো গোসলের আগে মাখতে হয়না। তেল গোসলের পরে মাখতে হয় এটা ইমোলিয়েন্ট/সুদিং ইফেক্ট হিসাবে কাজ করে। সরিষার তেল নয়, নারিকেলের তেল সবচেয়ে ভালো।
➡ নিজের পোশাক, তোয়ালে, চিরুনী নিজেটাই ব্যবহার করা উচিৎ। নো শেয়ারিং।
এবার বলুন তো এগুলো কি আপনাকে একটা ফ্রেশ লুকিং দিবে না? ফর্সা হওয়াটাই আসল কথা না— নিজেকে ও নিজের স্কীন কে সজীব, প্রানবন্ত, উচ্ছ্বল, হাস্যজ্জ্বোল রাখাটাই হলো ফর্সা।
সবশেষে একটা কথা বলবো- আমি মনে করি ” যিনি সুন্দর মনের অধিকারী তিনিই প্রকৃত অর্থে ফর্সা ”
সবাই ভালো থাকবেন।
Dr. Tania Hafiz
Z.H Sikder Women’s Medical College and Hospital
কারিতাস ঠিকানা প্রকল্প
মিরপুর, রুপনগর, ঢাকা-১২১৬
কারিতাস বাংলাদেশ
স্টাফ রিপোর্টারঃ জামিল সিদ্দিকী
ছবিঃ সংগৃহীত