মুহূর্তগুলো – ডা. মাহমুদ এইচ ইব্রাহিম

প্ল্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ -১০

” মুহূর্তগুলো “

ডা. মাহমুদ এইচ ইব্রাহিম
ঢাকা মেডিকেল কলেজ

 

টাকা দিলেও ছুটির দিনে কেউ ভোরে ঘুম থেকে উঠাতে পারবে না। দুদিন আগেও তেমনই ছিল চিন্তা ভাবনা। শরীরটাকে বিছানা থেকে টানতে টানতে সেটাই ভাবলাম। আর এখন টাকার প্রলোভন ছাড়াই উঠে যাচ্ছি। টেকনিক্যালি বললে টাকা পাচ্ছি। তবে সেটার পরিমান এত কম, কেউই তাতে লোভে পড়বে কি না সন্দেহ। এই সপ্তাহেই খেটেছি ষাট ঘন্টার উপর। মাসে যদি ২০০ থেকে ২৫০ ঘন্টা কাজ করি, ঘন্টা প্রতি বেতন আসে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। নাহ অর্থের লোভে না বরং বলা যায় ঠেলায় পড়ে উঠছি। ডাক্তারি পড়া শুরু থেকে এই পর্যন্ত সব কিছুই তো ঠেলায় পড়ে। এখন ওয়ার্ডে গিয়ে রোগীদের ফলো আপ দিতে হবে, ড্রেসিং করতে হবে। স্যার বেশ কড়া, দেরি করে গেছি জানতে পারলে পরদিন ঝাড়ি নিশ্চিৎ। সবার সামনে। ইন্টার্ন ডাক্তার সবার থেকে জুনিয়র, তার সম্মানটাও যেন সবার থেকে কম। অনেকে তো ডাক্তারই মনে করেন না।
রোগীদের ফলোআপে তেমন কষ্ট নেই, কষ্ট হলো গ্যাংগ্রিনের রোগীর ড্রেসিং। একজনের অবস্থা ভয়াবহ, হাঁটুর নিচ থেকে চামড়া বলতে কিছু নেই। সব মাসল দেখা যায়, নিটারের বইয়ের সাথে মিলিয়ে দেখা যাবে, এমন অবস্থা। আর যা গন্ধ! যতক্ষন ড্রেসিং চলে ততক্ষন এয়ার ফ্রেশনার দিতে হয়। সাথে যোগ হয় রোগীর আর্তনাদ। রোগীর ভালোর জন্যই ড্রেসিং করছি, তবু আরেকজন মানুষকে ভালো রকমের ব্যথা দিচ্ছি, মনের উপর কিছুটা হলেও চাপ সৃষ্টি করে। এই রোগীর কথা ভাবলেই ওয়ার্ডে যেতে ইচ্ছা করে না, আবার এই রোগীর কথা ভেবেই ছুটির দিনেও ওয়ার্ডে সময়মতো হাজির হই।
মেডিকেলে ভর্তির পর থেকেই আগের বেশিরভাগ ধারণাই ভেঙ্গে গেছে। যেমন ডাক্তারি পেশায় অনেক সম্মান, অনেক টাকা পয়সা। তবু হাউস এমডি টাইপের টিভি শো দেখে মনে ধারণা ছিল, হয়তো ডাক্তারি করাটা কিছুটা চাকচিক্যময় হবে। ইন্টার্নিতে ঢুকে সেই ধারণাও ভেঙ্গে গেছে। ডাক্তারির অনেকখানিই কেরানিগিরি। সেই সাথে ড্রেসিং করার মতো কিছু নীরস কাজ। সেই কাজের জন্য মেডেল সার্টিফিকেট নেই, নেই সেলফি তুলে ফেইসবুকে দেওয়ার সুযোগ।
আধ ঘন্টার উপর রোগী আর ডাক্তার দুজনের উপর দিয়ে দুধরনের ঝড় চললো, তারপর ড্রেসিং শেষ হলো। সব কাজ শেষ করে চলে আসবো, তখন রোগী আমাকে ডাকলেন। ভাবলাম, কোনো সমস্যা হচ্ছে হয়তো উনার। উনি কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘আমার জন্য অনেক কষ্ট করতেছেন। অনেক দোয়া করি বাবা।’ একই সাথে আমার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। আমি অনেক বুঝিয়ে তাকে টাকা ফেরত দিলাম।
রোগীর কথা বা টাকা দেওয়ার চেষ্টা না, মনে দাগ কাটলো তার অভিব্যক্তি, তার কৃতজ্ঞতা, তার ভালোবাসা। মানুষের ভালোবাসা উপেক্ষা করা খুব কঠিন। এই ভালোবাসার মায়ায় জড়িয়েই মানুষ আটকে যায়। কদর নেই জেনেও অনেকে বিদেশ থেকে দেশে ফিরে আসেন, কসাই ডাক শুনেও একদল মানুষ রাতদিন সেবা দিয়ে যান।
ছোট্ট সেই মুহূর্ত, যা ক্যামেরার ফ্রেম বা লিখনী কোনটাতেই বাঁধা যায় না। ক্ষণস্থায়ী এক মুহূর্ত। কিছুক্ষন বা কিছুদিনের মধ্যেই সেই অনুভূতিগুলো হয়তো সব হারিয়ে যাবে। তবু সেই মুহূর্তটাকে মনের ভিতর বাঁধিয়ে রাখার চেষ্টা করি। চারিদিকের অপ্রাপ্তি আর হতাশা যখন মনটাকে গ্রাস করতে চাবে তখন এই মুহূর্তই যেন আলো হয়ে পথ দেখায়। মান-সম্মান, টাকা-পয়সা বা ডিগ্রী নয়, এ রকম ছোট্ট ছোট্ট মুহূর্তের জন্যই না ডাক্তারি করা সার্থক।
এদেশে ডাক্তারি করতে হলে এটাই বার বার নিজেকে মনে করিয়ে দেওয়া লাগে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

বিশ্বাসে মিলায় ভূত - শাফকাত সিনহা

Sun Sep 2 , 2018
প্ল্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ -১১ “বিশ্বাসে মিলায় ভূত” লেখকঃ শাফকাত সিনহা রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ । বছর পাঁচেক আগের কথা। রোজার ঈদে দাদাবাড়িতে ফুপুরাও ছিল আমাদের সাথে। ঈদের পরদিন। গল্প করে আর টিভি দেখেই দিন কেটে গেছে। আকাশটাও মেঘলা। তাই বেরোনোও হয়নি ঘর থেকে। ফুপু সন্ধ্যার একটু আগে বলল কিছু জিনিস লাগবে। […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo