প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১২ ডিসেম্বর ২০২০, শনিবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
পঁচিশ বছর বয়সী যুবকটি বিএমডিসির একটি নাম্বার নিয়ে যখন ছোট রাস্তা পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠলো, সময়টা তখন মধ্যাহ্ন।
পায়ের নিচে পিচগলা গরম তাকে বুঝাচ্ছিল এ পৃথিবীতে শুধু দাঁড়িয়ে থাকাই কত কষ্টকর! জীবন এ পর্যায়ে জানালো পৃথিবী ঠিক গোল নয়, একটু চাপা। এ চ্যাপ্টাকৃতির কারণ গতি। সুতরাং গতি-ই জীবন। তাই ছুটতে হবে। জীবনের ব্যস্ত কক্ষপথে ছুটতে গিয়ে নীতির কক্ষপথ থেকে একটু বিচ্যুতি ঘটলো। এ দেশে এ বড় ঘটনা নয়। কঠিন পরিশ্রমের ফাঁকে চলল পড়ালেখা। ডাক্তারের পরিবার থেকে অভিযোগ উঠলো কাছে না পাওয়ার। সে বুঝালো জীবনের কেবল শুরু, এটিই সময়। এক সময় রেজাল্ট হলো। মিষ্টি বিলানো হলো। সাথে নামের পিছনে কিছু এলফাবেট যুক্ত হলো। পোষ্ট গ্রেডুয়েশনে সুযোগ পেলেন। আচমকা ‘সে’ থেকে ‘তিনি’ তে উত্তীর্ণ ঘটলো। জীবনে একটু স্বাচ্ছন্দ্য আসলো। পাল্লা দিয়ে বাড়লো ব্যস্ততা। নামের পিছনের অক্ষর সব স্থায়ী করার জন্য আরো বেশি শ্রম দিতে লাগলেন। শুক্রবারের ছুটি বাতিল হলো। বহু আগেই বাতিল হয়েছে সরকারি অন্য ছুটি গুলো। পরিবার থেকে আবার অভিযোগ এলো। তিনি বুঝালেন আরেকটু স্বাধীনতা দরকার।
কোন শ্রমই বৃথা যায় না। তিনি শেষ পরীক্ষাতে পাশ করলেন। স্বাধীনভাবে প্র্যাকটিস শুরু করলেন।
জীবন ঘড়ি দেখে চলে না, কারণ ওর সেকেন্ডের কাঁটাটাই জীবন। মাঝে মাঝেই শহর ছেড়ে বাইরে যান। সুখ বেঁচে স্বাচ্ছন্দ্য কেনেন। এক দুইবার সবাইকে নিয়ে দেশের বাইর থেকে ঘুরে এলেন। তারপরও পরিবার থেকে অভিযোগ উঠলো তিনি সময় দেন না। তিনি বুঝালেন ‘সব’ তাদের জন্যই করছেন। তিনি জানেন কিভাবে স্বপ্নকে তাড়া করতে হয়। সময়ের সাথে কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন। ব্যস্ততার ভিড় তার খাওয়া- দাওয়ার সময়কেও কেড়ে নিল। অর্থের সাথে ক্ষমতাও তিনি পেলেন। দেশের সবচেয়ে অভিজাত এলাকায় বাড়ি কিনলেন। মর্যাদা পেলেন সফল ব্যক্তিত্বের। ছেলেপুলেরা কখন বড় হয়ে বিয়ে করে ফেলেছে তিনি টের পান নি। আজকাল নাতিদের দেখে তাদের শৈশব দেখেন। ভারী আনন্দ হয়। একটু পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। সময় না দেয়ার অভিযোগ গুলো একদম মিথ্যে মনে হয় না।
শিশু এক চমৎকার খেলনা। এ ভেবেই অনেক আনন্দ ‘একদিন আমরাও এরকম খেলনা ছিলাম!’ আর ছিল কিছু খেলোয়াড়। একান্ত আমাদের জন্য। জীবন নদীর কোন বাঁকে তারা হারিয়ে গেছে! এক সন্ধ্যায় পরিবারের সবাইকে ডাকলেন। বললেন তার দায়িত্ব শেষ। কাল থেকে তিনি পরিবারে আরো বেশি সময় দিবেন, রাতের ডিনার সবাইকে নিয়ে একসাথে করবেন। কিন্তু তার সেই রাতের ঘুম আর ভাঙ্গলো না। সে ছোটকালে ছোটখাটো এক মানুষ ছিলেন ‘দিদা’। সাদা শাড়ি, টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ, গুঁজো হয়ে হাঁটতেন। চকির এক কোনায় বসে নিবিষ্টচিত্তে কাঁথায় ফুল ফোটাতেন। ওই একটি সময় চোখে চশমা থাকতো। এক কাঁথা শেষ হলে আরেক কাঁথা। কেন, কার জন্য, কাকে দিবেন- ভাবতেন না। মাঝে মধ্যে ডাকতেন সুঁইয়ে সুতা পরিয়ে দেয়ার জন্য। পাঁচ, সাত বছর আগেকার আরও ছোটবেলার কথা বলার জন্য। লতা- পাতা, ফুল- ফল, মেঘ, গাছ আঁকার জন্য। আমরা তখন ব্যস্ত বার্ষিক পরীক্ষা নিয়ে, বৃত্তি পরীক্ষা নিয়ে। একদিন ফোন আসলো তিনি নেই, মারা গেছেন। তিনি ছিলেনই না ব্যস্ত শিডিউল আর ভরা সিলেবাসে। এখন দেয়ালের ছবিতে নিষ্পলক চেয়ে থাকেন। কালো ফ্রেমে ধুলা জমে। কাঁথাগুলো পুরনো হবার ভয়ে গায়ে দেয়া হয় না। এরজন্য কাঁথার ক্ষয়রোগ অবশ্য থেমে নেই! সুতোয় তোলা ফুলগুলো বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। জানি আর কয়েক বছর পর স্পর্শ ও স্পর্শানুভূতি দুইই হারাবে। বার্ষিক পরীক্ষা, বৃত্তি পরীক্ষা, রচনালেখা প্রতিযোগিতা- সে কবেই হারিয়েছে।
জীবন দুই দিনের। বর্তমান নিয়ে বাঁচুন। কালকের কথা কে বলতে পারে?