প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২০ ডিসেম্বর ২০২০, রবিবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
‘ঈশ কী পাষণ্ডের মত মেরেছে!’ সেলাই দিতে দিতে পাশ থেকে বললো। যার হাতে সেলাই দেয়া হচ্ছে সে একজন নার্স। চোখ মুখ নির্বিকার। সুঁই ফোটানোর ব্যথা পাচ্ছে কী পাচ্ছে না বোঝা যাচ্ছে না। আমাদের ইমার্জেন্সির লোকাল এনেস্থিসিয়ার বোতল শেষ হয়েছে কয়েকদিন হয়। রোগীদের দিয়ে আনাই। সে রাজি হলো না।
ছোট কাগজে লিখতে লিখতে বললাম ভাল ঔষধ লিখে দিচ্ছি দ্রুত সেরে যাবে। বললো ‘স্যার সন্দেহ কমানোর কোনো ঔষধ আছে?’ কথাটির মধ্যে এমন কিছু ছিল যে বাধ্য হলাম মুখের দিকে তাকাতে। দেখলাম তার চোখে শারীরিক কষ্টের কোনো চিহ্ন নেই, সব জ্বালা অপমানের। এ লাঘবের কোনো ঔষধ জানা নেই। ত্রিশ বত্রিশ বয়স হবে। বাসায় স্বামী পঙ্গু আজ চার বছর হয়। সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছিল। বাসার খরচ, ছেলে- মেয়েদের পড়ার খরচ, পঙ্গু স্বামীর চিকিৎসার খরচ এক সরকারি বেতনে হয় না। তাই অবসরে এক ধনাঢ্য ব্যক্তির বৃদ্ধা মায়ের নার্সিং করে। স্বামীর সন্দেহ তার কোনো গোপন প্রণয় আছে। সে জেরেই অশান্তি। তারপর যা হয়! স্বামী পঙ্গু বলেই তো তার স্বামীত্বের অধিকার পঙ্গু নয়। পুরুষত্ব মানে শারীরিক জোর, রাগ, হিংস্রতা। পঙ্গু ব্যক্তি এখানে একটু ‘পুরুষত্ব’ দেখিয়েছে!
এরকম আমি দেখেছি। এ পৃথিবীটা এমন- যে এখানে কোনো কিছুই একবার ঘটে না, হয় অন্তত দুইবার ঘটবে, নয় কোনদিন ঘটবে না। এরকম এক লোক আগেও দেখেছিলাম। তার সন্দেহ তার প্রেমিকাকে নিয়ে। একবার কোনো ভাবে সে তার ভাবী বউয়ের পাসওয়ার্ড যোগাড় করে। তারপর দিন রাত খুঁজতে থাকে কে তার সাথে ম্যাসেঞ্জারে যুক্ত, কে তার ছবিতে লাইক লাভ দেয়, কার সাথে কথা হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। তার ধারণা ছিল কোনো ছেলে হয়তো মেয়ে ছদ্মনামে আছে। তারা ইটিশপিটিশ করছে পুরো পৃথিবীকে লুকিয়ে। সে সবার প্রোফাইল চেক করতো। ফ্রেন্ডের ফ্রেন্ডের ফ্রেন্ড। এক শাখা থেকে আরেক শাখা। একসময় যখন আর কিছুই বাকি থাকে না, মারাত্মক কিছু আবিষ্কারও হয় না- সে হতাশ হয়ে পড়ে। তার সব রাগ গিয়ে পড়ে সবার উপর। তার গার্লফ্রেন্ড অবিশ্বাসিনী নয়- এতে তার খুশিই হওয়ার কথা, কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো কেউ তাকে ঠকিয়েছে। পুরো বিশ্ব- সংসার একাট্টা হয়ে তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছে। তার প্রাপ্য তার কাছ থেকে লুকিয়ে ফেলা হয়েছে। সন্দেহ ক্যান্সারের মতো। একবার ধরার পর বাড়তে থাকে। ছড়াতে থাকে নিজের মর্জি মাফিক। ততক্ষণ, যতক্ষণে না সম্পর্কের মৃত্যু হচ্ছে। তবে সেদিন আমরা অনেক বলেও তাকে পুলিশ খাতায় নাম তোলাতে পারি নি। উল্টো সে আমাদের অনুরোধ করেছিলো তার এভাবে আসার কথাটি গোপন রাখতে। ডাক্তারের এথিকস আছে। সামান্য ফেসবুকারের আর কী এথিকস! তাই আজ লিখে দিলাম। আমার এক বন্ধু আজ কথা প্রসঙ্গে বলেই ফেলেছে তুমি আজ একটা বলছো তো কাল আরেকটা, কখনো কখনো সম্পূর্ণ বিপরীতার্থক। তাই হবে। আগামাথা ছাড়া লেখা, ছাড়া গরুর মতো, বাসায় ফেরার বালাই নেই। তাই এরা ঠিক ঠিকানা বিহীন।
আজ আকাশে বাঁকা এক চাঁদ উঠেছে। অর্ধচন্দ্র। এখন সন্ধ্যারাতে আকাশে চাঁদ দেখা যায়, তারপর নেই। নয়টা দশটার দিকে আকাশ কালো। সম্ভবত কুয়াশার জন্য। চাঁদের নরম আলো কঠিন পৃথিবীর বুকে আর ঠিকরে পড়ে না। শূন্যতা শূন্যতায় হারিয়ে যায়। এ গল্পগুলো ঘন কালো বড় বড় পল্লবওলা চোখের জলের গল্পই নয় শুধু, তার ভেতরকার জ্বলা আগুনেরও। যাই হোক আর যেভাবেই হোক, একটি তো কারণ থাকতে হবে দাতা মানুষের কাছা- কাছি থাকার। তা যখন উন্মোচন হয় না সে রাগ আগে নিজেকেই পোড়ায়। পরে অন্যকে।