‘টাইটানিক’ সিনেমার নায়িকা রোজের বিচ্ছেদ ব্যথায় অশ্রু বিসর্জন করেননি, এমন মানুষ সম্ভবত কমই আছেন। হয়তো ভাবছেন, ধান ভাঙতে শিবের গীত গাইছি কেন। গাইছি কারণ মাঝে মধ্যে এমন ট্রাজেডি থেকেই বিজ্ঞানের কোনো মহৎ আবিষ্কারের সূচনা হয়। (আমায় হৃদয়হীন ভাববেন না দয়া করে, রোজের বেদনা আমাকেও ছুঁয়ে গিয়েছিল। )
এই যেমন টাইটানিক ডোবার পরই জলের তলার বস্তু খুঁজে বের করতে নতুন প্রযুক্তির দরকার পড়ে। একাজে আলট্রাসাউন্ড ব্যবহারের চিন্তাটা প্রথম এসেছিল পল ল্যাঙ্গেভিন এর মাথায় (১৯১৫)। তাঁর এ চিন্তাটা ফরাসি সরকারের পছন্দ হয়ে যায় এবং তিনি নিয়োগপ্রাপ্ত হন এমন একটা যন্ত্র বানাবার জন্যে, যা জলের নিচে শত্রুর সাবমেরিন শনাক্ত করতে সক্ষম; প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষমতার লড়াইয়ে টিকতে হলে এমন একটা কিছু দরকার ছিল ফ্রান্সের। ফ্রান্স সরকারের আশাটা অবশ্য পূরণ হয়নি, কেননা ল্যাঙ্গেভিন যথাসময়ে কাজ শেষ করতে পারেননি। তিনি তাঁর ‘হাইড্রোফোন’ তৈরি করেন ১৯১৭ সালে, যার অনুপ্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন ১৯১২ সালে রিচার্ডসন আবিষ্কৃত ‘sonar detection system’ থেকে।
আল্ট্রাসাউন্ডের ইতিহাসটার সূচনা হয়েছিল আরো আগে, ১৭৯৪ সালে, যখন Lazzaro Spallanzani বাদুড়ের চলাচলে আল্ট্রাসাউন্ড ব্যবহারের ধারণা দেন। ১৮৮০ সালে বিখ্যাত বিজ্ঞানী পিয়েরে কুরি এবং তাঁর ভাই জ্যাকুয়েস কুরি piezoelectric effect আবিষ্কার করেন। বিষয়টা হলো কোয়ার্টজ স্ফটিকে মেকানিক্যাল বা আল্ট্রাসাউন্ড কম্পনের ফলে ইলেক্ট্রিসিটি উৎপন্ন হয়। এ আবিষ্কারের পরই মূলত এ প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়ন শুরু হয়।
১৯২০ এর দশকে আল্ট্রাসাউন্ড প্রধানত ইউরোপীয় সকার দলগুলোর খেলোয়াড়দের ফিজিক্যাল থেরাপি হসেবে ব্যবহৃত হতো। পরবর্তী দুই দশকে আল্ট্রাসাউন্ড থেরাপি অনেকটা ‘সর্ব রোগের মহৌষধে’ পরিণত হয়। বাতের ব্যথা থেকে গ্যাস্ট্রিক আলসার কিংবা একজিমা সবক্ষেত্রেই এর ব্যবহার ছিল। ১৯৩৭ সালে কার্ল ডুসিক এবং তাঁর ভাই ফ্রেডরিক প্রথমবারের মতো মস্তিষ্কগহ্বরের টিউমার সনাক্ত করতে আল্ট্রাসাউন্ড ব্যবহার করেন (হাইপারফোনোগ্রাফি)। এরপর ১৯৪০ এর দশকের শেষভাগে জর্জ লুডউইগ মেরিল্যান্ডের নেভাল মেডিকেল রিসার্চ ইন্সটিটিউটে কাজ করার সময় গলস্টোন সনাক্ত করতে আল্ট্রাসাউন্ড প্রযুক্তি ব্যবহার করেন।
মেডিকেল আল্ট্রাসাউন্ড প্রযুক্তির আরো একজন অগ্রদূত হলেন গ্লাসগো রয়্যাল ম্যাটার্নিটি হাসপাতালের প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ ইয়ান ডোনাল্ড। চিকিৎসক হলেও ছোটবেলা থেকেই যন্ত্রপাতির প্রতি তাঁর ছিল দুর্বার আকর্ষণ। বিখ্যাত বয়লার কোম্পানি Babcock & Wilcox এর পরিচালকের স্ত্রীর চিকিৎসক হবার সুবাদে তিনি কোম্পানির রিসার্চ ডিপার্টমেন্টের আল্ট্রাসাউন্ড যন্ত্রপাতি তাঁর গবেষণায় ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে যান। এর মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন morbid anatomical specimen এর সনোগ্রাফিক চরিত্র আবিষ্কার করেন। তিনি তাঁর সহকর্মী ডোনাল্ড ম্যাকভাইকার ও অপর একজন চিকিৎসা বিজ্ঞানী টম ব্রাউনের সাথে মিলে যন্ত্রটির আরো উন্নতি সাধন করেন এবং বেশ কিছু রোগীর প্যাথলজি শনাক্তকরণে এর ব্যবহার করেন। ১৯৫৮ সালের ৭ জুন The Lancet পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁদের গবেষণাপত্র “Investigation of Abdominal Masses by Pulsed Ultrasound”। প্রফেসর ডোনাল্ড এবং জেমস উইলক আল্ট্রাসনোগ্রাফির আরো উন্নতি ঘটান এবং একে মাতৃগর্ভে ভ্রূণের মাথার ব্যাস মাপতে ব্যবহার করেন, যা কিনা ভ্রূণের বিকাশ পর্যবেক্ষণের নতুন দুয়ার খুলে দেয়।
বিজ্ঞানের সব শাখায় সম্ভবত একজন করে ‘গ্যারেজ/বেসমেন্ট বিজ্ঞানী’ আছেন। হতে পারে তাঁরা দাম্পত্যসঙ্গীর প্রতি বিরক্ত হয়ে বাড়ির গ্যারেজকেই শান্তিতে কাজ করার স্থান হিসেবে বেছে নিতেন। 😉 আল্ট্রাসাউন্ডের ইতিহাসে এমন বিজ্ঞানী হলেন কলোরাডো বিশ্ববদ্যালয়ের রেডিওলজিস্ট ডগলাস হাওরি, যিনি ১৯৪৮ সালে তাঁর নিজের আবিষ্কৃত B মোড আল্ট্রাসাউন্ড যন্ত্র ব্যবহার করে cross-sectional anatomy এর সাথে gross pathology এর তুলনা করতে সক্ষম হন। এ প্রযুক্তির উন্নতিতে আরো অবদান রাখেন জন উইল্ড, যিনি ১৯৫০ সালে ব্রেস্ট টিউমার সনাক্ত করার জন্য হাতে ধরার উপযোগী প্রব তৈরি করেছিলেন এবং জোসেফ হোমস যিনি প্রথম হাওরি এর সাথে মিলে 2D স্ক্যানার তৈরি করেছিলেন।
‘Echocardiogram’ এর জনক ইংগে এডলার এবং হেলমাথ হার্টজ ১৯৫৩ সালে একটি জাহাজ কোম্পানির আল্ট্রাসাউন্ড যন্ত্র ধার করে প্রথমবারের মতো হৃদপিন্ডের কার্যক্রম মাপতে সক্ষম হন। হার্টজ তখন ছিলেন লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, আর এডলার নামকরা কার্ডিওলজিস্ট। তাঁদের দেখা হয়েছিল একদিন লাঞ্চের সময়। কথাপ্রসঙ্গে এডলার জানতে চেয়েছিলেন মানবদেহের কার্যপ্রণালী দেখার জন্যে রাডার ব্যবহার করা যায় কিনা। হার্টজ তাঁকে রাডারের পরিবর্তে আল্ট্রাসাউন্ড ব্যবহারের পরামর্শ দেন। তারপরের ইতিহাসটা তো আমরা জানিই।
১৯৬০ এবং ৭০ এর দশকে আল্ট্রাসনগ্রাফি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। ষাটের দশকের শেষ দিকে ওয়াশিংটন বিশ্ববদ্যালয়ের জিন স্ট্রান্ডনেস ভাস্কুলার রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ডপলার আল্ট্রাসাউন্ড ব্যবহারের ধারণা দেন। এ প্রযুক্তির উন্নয়নে আরো অবদান রাখেন ডন বেকার, ডেনিস ওয়াটকিন্স এবং জন রেইড। প্রথম কালার ডপলার আল্ট্রাসাউন্ড মেশিন তৈরি করেন জিওফ স্টিভেনসন। ১৯৮৬ সালে টোকিয়ো বিশ্ববদ্যালয়ের বিজ্ঞানী কাজুনোরি বাবা প্রথমবারের মতো 3D আল্ট্রাসাউন্ড প্রযুক্তির সাহায্যে গর্ভস্থ ভ্রূণের ত্রিমাত্রিক ছবি ধারণে সক্ষম হন। পরবর্তীতে ৯০ এর দশকে 4D আল্ট্রাসাউন্ড প্রযুক্তির আবিষ্কার ‘রিয়েল টাইম ইমেজিং’ এর ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধন করে।
আবিষ্কারের প্রায় এক শতাব্দী পর আজ আল্ট্রাসনোগ্রাফি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ডায়াগনোস্টিক টুলগুলোর মধ্যে একটা। জীবনের জন্য অতি প্রয়োজনীয় অসাধারণ এ প্রযুক্তির দিন দিন উৎকর্ষতা বেড়েই চলেছে। 🙂
©
আব্দুর রাফি,
রাজশাহী মেডীকেল কলেজ ।