থার্ড ইয়ারের সাথে ইন্টার্ণ এর মিল হলো দুটোতেই নতুনত্ব আছে, ঠিক যেন কাদামাটি!
কেউ যখন ফার্স্ট প্রফের চাপে গলতে গলতে তৃতীয় বর্ষে উঠে তখন তারকাছে মনে হয় বিধাতা যেন তাকে কোন দড়ি দিয়ে টেনে তুলেছেন। সবচেয়ে ভালো স্টুডেন্টটাও কিন্তু খুশীতে নড়েচড়ে বসে, মেডিকেলটা এমনই! সাগরের ঢেউ এর মাঝে কত কত ডিংগী নৌকা ভেসে থাকে আর বিশাল টাইটানিক ডুবে যায়! ভালো ছাত্ররা মাঝে মাঝে টাইটানিক হয়ে যায়, ব্যপার না, ২০১৩ সালের টাইটানিক আজোও নিজের
নাম ধরে রেখেছে।
থার্ড ইয়ারে একটা স্ট্যাথোস্কোপ আমরা সবাই পেয়ে যাই! সেটাকে দড়ি বানিয়ে ফাইনাল প্রফ এর উচ্চতা অতিক্রম করেই ইন্টার্ন! বাকী জীবন এই স্ট্যাথোস্কোপটাই যেন প্রতীক হয়ে থাকে, কষ্টে, দুঃখে স্বপ্ন দেখায়। তৃতীয় বর্ষে স্ট্যাথোস্কোপের ব্যবহারটা ভালো ভাবে করতে পারলে ফাইনাল প্রফের ঝামেলা অনেক কমে যায়।
হ্যাঁ, ক্লিনিক্যাল এক্সামিনেশান এর কথাই বলছি। এই ক্লিনিক্যাল এক্সামিনেশান করতে করতেই আমরা স্বপ্নের দারে আধো দোলা দেই। তখন থেকেই গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাবার শুরু।
সারা জীবনতো চটি বই পড়ি, তাই না? এতে কোন সমস্যা নাই। কে কি বই পড়লো সেটা মূখ্য না, কে কতটা পারলো সেটাই বড়। Macleod’s Clinical Examination নামে একটা বই আছে। সহজ, প্রাঞ্জল, দেখতেও সুন্দর। Thirteenth Edition এর বইটাতে 451 পেইজ আছে। কিছু পেইজ পড়া লাগে না সূচি, রেফারেন্স, ইত্যাদি। তো ক্লিয়ার হিসেব করলে 400 পেইজ!
– General Examination.
– Respiratory System.
– CVS, Precordium Examination.
– Abdomen Examination.
– Nervous System.
জাস্ট এই পাঁচটা সিস্টেম এক্সামিনেশান এই বইটা থেকে পড়তে কারো কত দিন লাগতে পারে? এখানে সব মিলিয়ে 5 টা অংশ! ১ মাস করে ধরলে ৫ মাস। আমি এক বছর সময় দিলাম। এই সাথে ইউটিউবে ভিডিও পাওয়া যায়। শুধু পড়লে হবে না, নিজে নিজে এক্সামিশান করে, ফাইন্ডিং বলার চেষ্টা করতে হবে।
লাইক,
After General Examination of this patient, I found,
or, General Examination of this patient revels,
এরপর কি কি পাওয়া গেল সেটা বলার প্রক্টিস করা! দ্যাটস অল।
History লিখার পাশাপাশি মেথডিক্যালি এই এক্সামিনেশান গুলো করা প্র্যাক্টিস করলেই ক্লিনিক্যাল কেইস এর জড়তা কেটে যায়।
প্রতি সপ্তাহে দুইটা রোগী দেখে হিষ্ট্রি নেয়া প্র্যাক্টিস করলে এক্সামিনেশান এর চর্চা আর লং কেইস রেডি করার চাপ আর থাকে না।
এখন প্রশ্ন হলো, থার্ড ইয়ারে এই কাজ করার টাইম কোথায়?
থার্ড ইয়ার প্যারা ক্লিনিক্যাল সাব্জেক্টের মাঝে মেডিসিন, সার্জারী পড়া একটু কঠিন তাই আমার উত্তর হলো রাতের ওয়ার্ড!
রাতে কেউ কেউ ওয়ার্ড মিস দেয়, কারন, ওরা টিউশানী করে। আমিও করতাম। আমি বুঝি। সপ্তাহে সাত দিন টিউশানী করে ওয়ার্ড মিস দিলে কিন্তু বিপদ। মাঝে মাঝে ক্লাশ না করলে অনেক ডিউ জমে যাবে, সো সাবধানের মার নেই, কিছু ব্যপার হালকা ভাবে নিলে পরে সেটা অভ্যাসহীনতায় বিরক্তির উদ্রেক করে, তাই সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়, অল্প হোক কিম্বা বেশী।
ফাঁকি দাও আর যাই করো, সপ্তাহে এক- দুইটা হিস্ট্রি লিখার অভ্যাস করতেই হবে। এক্সামিনেশান করতেই হবে। সবচেয়ে বড় কথা লজ্জা আর ভয় বাদ দিয়ে দুই তিন জন মিলে একমাস একটু প্র্যাক্টিস করলেই কিন্তু হয়ে যায়। সবচেয়ে বড় কথা থার্ড ইয়ার এ যা শেখা হয় তাই আজীবন মনে থাকে। আমি নিজেই আজ এই জিনিসটা ফিল করি।
এতবছর পর এখন আমার শুধুই মনে হয়, ইস! আবার যদি থার্ড ইয়ারে পড়তে পারতাম, ইস, ভুল করলে কেউ লজ্জা দিতো না। এখন, বড় হয়ে, যখন গ্রস মিস্টেইক করি লজ্জায় মরে যাই আর ভাবি কেউ কেন একটু বললো না আমাকে, এক ঘন্টা দুই ঘন্টা সময় দেয়া কি খুব কঠিন ছিলো? না হয় চা খাওয়ার আড্ডায় এক ঘন্টা সময় কম কাটাতাম!! রিকভারীর চেষ্টা করেই চলেছি!
এবার আসি ইন্টার্ন দের বেলায়। এখানে আমরা পুরো ডাক্তার। এখানেও থার্ড ইয়ার এর স্টেথোস্কোপ থিওরী কাজে লাগাই। যারা আউড ডোর বা ইনডোরে রোগী দেখেন , সময় স্বল্পতা আর রোগীর চাপে উনারা এক্সামিন করতে পারেন না। ফলে এক্সামিনেশান এর গ্যাপটা থেকেই যায়।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি, যখন উপজেলায় সরকারী চাকুরীতে গেলাম, চেম্বার করা শুরু করলাম, দেখলাম, রোগীদের সাথে ভালোভাবে কথা বললেই ওরা খুশী। এরপর দেখলাম, আমার ব্যস্ততা বাড়ছে, রোগীরাও অপেক্ষা করতে চায় না। সত্যি বলছি, কিছু রোগীকে দেখেছিলাম, প্রেস্ক্রিপশান লিখার আগেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে, হাসপাতালে কিছু রোগী প্রেসার ছাড়া কিছুই দেখাবে না। সো আমার মাঝেও একটা অনীহা চলে আসতে শুরু করলো। অভ্যাস মারাত্মক ব্যপার। দ্রুত রোগী দেখতে গিয়ে এক্সামিনেশান মেথড এর বারোটা বেজে গেলো।
একদিন এক রোগী দুর্বলতার কথা বললো, সাথে গা চুলকানো। আমি তার জন্ডিস দেখতে গেলেই ধমক দিলো কি ডাক্তার আপনে? সমস্যা গায়ে আপনে চোখ দেখেন, আপনি কি চোখের ডাক্তার?
এসব অনীহায় একদিন আমি এক পেশান্ট এর জন্ডিস মিস করলাম। নিজের উপর রাগ হলো। সেই থেকে চেষ্টা করি, মেথডিক্যালি অন্তঃত জেনারেল এক্সামিনেশান, রেস্পিরেটরী আর এবডোমেন এক্সামিন করতে।
বেইজটা কিন্তু থার্ড ইয়ারেই হয় আর ইন্টার্নীতে সেটা এপ্লাই করলে স্টোথোস্কোপ দিয়ে এবনরমাল সাউণ্ড গুলো খুব সহজেই ধরতে পাওয়া যায়। পোষ্ট গ্রাজুয়েশন আর ব্যক্তিজীবনে ভালো ক্লিনিশিয়ান হতে গেলে নিজেকে মেথডিক্যালীই প্রস্তুত করতে হয়। বইয়ে সব থাকে কিন্তু প্র্যাক্টিস এর জিনিস নিজেকেই প্র্যাক্টিস করতে হয়, সময় চলে গেলে আর এটা করা হয় না।
থার্ড ইয়ারে নরমালটা ভালো শেখা থাকলে, সারা জীবন এবনরমাল ফাইন্ডিং নিয়ে আর ভাবতে হবে না!!
লিখেছেন: মৃণাল সাহা
পরিমার্জনা: বনফুল