প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৩ জুন, ২০২০, মঙ্গলবার
ডা. এ. এস. এম. রেজওয়ান চৌধুরী
জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ
সেশনঃ ২০১০-১১
আমি আমার প্রতিটি লেখায় চেষ্টা করি মেডিকেলের কৃষ্ণ গহবরে লুকিয়ে থাকা আলোক উন্মোচন করতে, অনুপ্রেরণার গল্পগুলোকে তুলে ধরতে। চেষ্টা করি মানবিক দিক গুলোকে নিঙড়ে বের করে আনতে। আরো একটি চেষ্টা থাকে- অনন্য চরিত্রগুলোকে সুবিন্যস্ত করতে, যাতে আমার অসম্ভব সুন্দর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যখন ছাত্র থাকবে; তখন সে যেন একজন অনুকরণীয় বন্ধু পায়, অনুকরণীয় বড় ভাই পায়, অনুকরণীয় শিক্ষক পায়। আবার সে ছাত্র যখন ডাক্তার হবে, তখন যেন অনুকরণীয় সহকর্মী ও রেজিস্ট্রার পায়। আজও তার ব্যতিক্রম নয়।
আজ লিখব এমন একজনকে নিয়ে যাকে নিয়ে হয়তো কেউ কখনো লিখবে না, যিনি তাঁর নিজ সম্প্রদায় দ্বারা ব্যাপক নিগৃহীত ছিলেন। এই চরিত্র থেকে আমাদের প্রধান শিক্ষণীয় বিষয় ধৈর্য ও হতাশামুক্ত জীবন। চিকিৎসকরা সবচেয়ে বেশি হতাশ সম্প্রদায়, ক্যারিয়ার ও পরিবারকে ব্যালেন্স না করতে পারায়। তাই আমার মূল আলোচ্য বিষয় এ দিকটি। একটা মানুষ তাঁর জীবদ্দশায় কতটা ধৈর্যশীল তা যারা তাঁকে কাছ থেকে দেখেননি, তারা বিশ্বাস করতে পারবেন না কখনোই। সেখান থেকে আমরা আরো শিখতে পারব অসম্ভব সহ্যশক্তি, অহিংসাপরায়ণতা, সততা, নিরহংকার, সাদাসিধে জীবন, দানশীলতা, হাস্যজ্জ্বলতা, ভালভাবে পড়ানোর জন্য প্রবল চেষ্টা। এছাড়াও সৃষ্টিকর্তার উপর পূর্ণ বিশ্বাস, অসাধারণ মানবিক গুণ, ছাত্রপ্রেম, পারিবারিক মূল্যবোধের জায়গাগুলো, পরামর্শ করে চলা ও অগ্রজদের মান্য করে চলা এবং ধর্মচর্চার গুরুত্বকে। সাম্প্রদায়িকতার ছোঁয়া থাকলে আমায় ক্ষমা করবেন, তবু যা দেখেছি তা আমাকে লিখে যেতেই হবে আমার অনুজদের জন্য।
বিধাতা তাঁর কোন সৃষ্টিকেই হয়ত সর্বগুণে গুণান্বিত করেন না। তাই আমরা কাউকেই পারফেক্ট বলতে পারি না। সকলের মাঝেই থাকে কিছু সীমাবদ্ধতা। আমরা কাউকে বাহির থেকে বিচার বিশ্লেষণ করি, আবার কাউকে করি খুব কাছ থেকে মিশে। তবে মুখ্য বিষয় তাঁর অনুকরণীয় গুণগুলিকে খুঁজে বের করা।
ফজলুল হক স্যার ছিলেন আমাদের প্যাথলজি শিক্ষক। প্রথমে তাঁর ধৈর্য ও হতাশামুক্ত জীবন নিয়ে লিখব। স্যার ছিলেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ছাত্র। তিনি কানে ভাল শুনতে পেতেন না, তাই ব্যাটারি চালিত ক্ষুদ্র যন্ত্র ব্যবহার করতেন কানে। শুনেছি মেডিকেল ছাত্রাবস্থায় তিনি ইসলাম চর্চা শুরু করেন, সুন্নত মেনে চলার চেষ্টা করতেন, দাঁড়ি রাখেন, পাগড়ি পরিধান করতেন, দীনের দাওয়াত দিতেন। তাঁর বন্ধুরা তাঁর দাঁড়ি টানাটানি করতেন, পাগড়ি খুলে ফেলতেন, হাসি ঠাট্টা করতেন, পাগল বলতেন। তিনি সব সহ্য করতেন এবং সবার জন্য দু আ করতেন। এই একঘরে থাকার মত, হীনমন্যতার ও বিদ্রুপের মানসিক চাপ আমরা কতটা সহ্য করতে পারতাম একমাত্র সৃষ্টিকর্তা জানেন।
এরপর তিনি এমবিবিএস পাশ করার পর দীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য ভারত ও পাকিস্তান চলে যান, সেখানে দাওয়াত দেওয়া শিখেন ও চর্চা করেন। প্যাথলজি বিষয়ে দুটি পোস্ট গ্রাজুয়েশন ডিগ্রী সম্পন্ন করে আমাদের মেডিকেল কলেজে প্যাথলজি বিভাগে যোগদান করেন। স্যারকে বেশি ক্লাস নিতে দেওয়া হতো না। কারণ প্যাথলজি ডিপার্টমেন্টের হেড অসম্ভব ভাল পড়াতেন, পড়াতে ভালবাসতেন, ছুটির পরেও ক্লাস নিতেন; আবার ছুটির দিনেও আগ্রহীদের নিয়ে ক্লাস নিতেন। অর্থাৎ একজন পড়ানো শেখানো শিক্ষক ছিলেন।
আমরা দেখতাম ফজলুল হক স্যার প্রায়ই দুপুর ১২ টার দিকে একটু ঝিমুচ্ছেন। একদিন দেখলাম আমাদের প্রিন্সিপাল স্যার তাঁর রুমে ঢুকে তাঁর মোবাইল নিয়ে চলে গেলেন টেবিল থেকে, তিনি টেরই পেলেন না। তিনি অসম্ভব লজ্জা পেয়েছিলেন পরে। আমরা জানতে পারলাম তাহাজ্জুত পড়ার কারণে তিনি সেই ঝিমুনিটিকে অতিক্রম করতে পারতেন না। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি তাঁর প্রবল চেষ্টা দিয়ে তা অতিক্রম করেন। প্যাথলজি ডিপার্টমেন্ট হেড স্যার চাকুরি ছেড়ে দেওয়ার পর তিনি ক্লাস নেওয়া শুরু করেন। কিন্তু সীমাবদ্ধতার কারণে তিনি তেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেন নি, শিক্ষার্থীরা মনোযোগ দিতো না। তিনি চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখেন নি। প্রচন্ড চেষ্টা করেছেন তাঁর পড়ানোকে প্রতিনিয়ত উন্নত করতে। কিভাবে প্রতিটি ছাত্র পরীক্ষায় পাশ করতে পারে, সেটি নিয়ে তিনি খাটাখাটুনি করতেন প্রচুর। সেই চেষ্টাটা ছিল আমাদের কাছে অনুকরণীয়। পড়ানো ও জ্ঞানের মূল্যায়ন করা ধৃষ্টতা বলে আমি মনে করি। তবে ছাত্ররা তাঁর কানে না শোনা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতো উনি তা বুঝতেন, তবে অনেকেই ক্ষমা চেয়েছে পরবর্তীতে।
তিনি হতাশামুক্ত জীবনে বিশ্বাসী মানুষ ছিলেন। সব কিছুর জন্য সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস রাখতেন। তিনি বলতেন,
“আমরা চেষ্টা করব, আমাদের জন্য যেটি উত্তম সৃষ্টিকর্তা জানেন এবং তিনি তা সময়মতো দিবেন যখন দরকার। পোস্ট গ্রাজুয়েশন আল্লাহর হুকুমে হবে, আল্লাহই পার করাবেন। এটি নিয়ে হতাশ হওয়া বা সুন্দর পারিবারিক ও সামাজিক জীবন নষ্ট করা কিংবা আখিরাত বাদ দেওয়া যাবে না। দুনিয়া ও আখিরাত দুটোই আল্লাহর কাছে চাও। আল্লাহ পরীক্ষা করবেন; ধৈর্য ধর, দুটোই পাবে। সবকিছু আল্লাহর পরিকল্পনায় হবে, তুমি শুধু চেষ্টা ও দুআ করবে।”
তিনি কোন কিছু নিয়ে আফসোস করতেন না, বলতেন,
“ধৈর্য ধর, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
তিনি সবার সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে শুনতেন, তারপর সেগুলোকে নিয়ে সবার সাথে পরামর্শ করতেন। সেখান থেকে বিজ্ঞ, প্রজ্ঞাবানরা পরামর্শ দিতেন। তিনি ছিলেন পরোপকারী। খুবই সাদাসিধে জীবন ছিল। একই রকম পাঞ্জাবি ছিল, চাকচিক্যহীন নকশাহীন এক কাপড়ের। স্যার বলতেন,
“এতে অন্তরে অহংকার সৃষ্টি হয় না।”
ফজলুল হক স্যার সদা সালাম বিনিময় করতেন। তিনি বলতেন, সালামের প্রচলন করতে, করমর্দন ও কোলাকুলি করতে, কুশলাদি বিনিময় করতে। এতে আন্তরিকতা বাড়ে। কখনো কোন কটু কথায় কারো উপর রাগ করেন নি। আলহামদুলিল্লাহ বলতেন। হাসিমুখে কথা বলতেন। বলতেন,
“হাসিমুখে কথা বলাও সদকার শামিল।”
এবার উনার দানশীলতা নিয়ে আলোকপাত করব। তিনি এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে যা বেতন পেতেন, তার প্রায় সমুদয় অর্থ দীনের রাস্তায় খরচ করতেন। মাস শেষে উনার অবস্থার কথা না বলি। তিনি ছাত্রাবাসের মসজিদে প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার বিকেলে বা সন্ধ্যার পর স্ত্রীর রান্না করা খাবার এবং ফলমূল নিয়ে আসতেন। তাঁর স্ত্রী এক মহিয়সী নারী চরিত্র, দীনের জন্য তিনিও তাঁকে সব সময় সাহায্য করেছেন। বাইরে থেকে মসজিদে জামাত আসলে তিনি তাদের মেহমানদারী করতেন। এছাড়া এলাকায় ও সবাইকে সাহায্য করতেন। জঙ্গী হামলার সময়গুলোতে তাঁরা কতৃপক্ষের রোষানলে পড়েন, দীনের দাওয়াত স্থগিত হয়।
পরিশেষে তাঁর পারিবারিক মূল্যবোধের জায়গা তুলে ধরব। তিনি পরিবার নিয়ে মাটিতে বসে খেতেন, অনেক সময় একই প্লেটে খেতেন। বাসায় কোন টিভি ছিল না। ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখী সুস্থ জীবনযাপন করতেন। স্ত্রীর হাতের গরম ভাত ও তরকারি খেতে দুপুরে চলে আসতেন ব্রেক টাইমে।হাসপাতালের ল্যাব ও কলেজ ভবনের মাঝখানে ছিল উনার কোয়ার্টার। এক ভবন থেকে অন্য ভবনে যাওয়ার সময় স্ত্রীর হাতে এক গ্লাস পানি খাওয়ার জন্য দেখা করতে আসতেন। প্রতিটি কাজে স্ত্রী, সন্তানের পরামর্শ ও মতামত নিতেন।
আমরা চাইলে শিক্ষা নিতে পারি অনেক কিছুই। আগামী পর্বে জানা বা অবহেলিত অনুপ্রেরণাগুলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করব।