প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৮ জুন, ২০২০, রবিবার
ডা. এ. এস. এম. রেজওয়ান চৌধুরী
জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ
সেশনঃ ২০১০-১১
আমরা প্রথম সারির বিজয়ী ছাত্রদের কথা জানতে ভালবাসি, কারণ তাদের হাতে ইতিহাস রচিত হয়। অথচ পিছনের সারির কিংবা অন্ধকারে নিমজ্জিত ছাত্রদের গল্পগুলো জানতে বা শুনতে চাই না। আজ আমি আমার অসম্ভব সুন্দর আগামী প্রজন্মের, তথা অনুজদের সেই পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের নিয়ে কাজ করা ত্রাণকর্তা সম্পর্কে জানাবো, হাল না ছাড়ার গল্প শোনাবো। যারা ক্ষমতাসীন পদে দায়িত্বরত থেকেও ক্ষমতালোভী হয়ে উঠেন নি, ক্ষমতার অপব্যবহার করেন নি এবং ছাত্রদের ভুলে যান নি। বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা ক্ষমতাসীনদের বার বার দস্যু হয়ে উঠতে দেখি। কিন্তু তাঁদের গল্পটা একটু ভিন্ন ছিল, ছিল শিক্ষণীয় ও অনুকরণীয়।
একজন ববি স্যার, ছাত্রমহলে বেশ জনপ্রিয় শিক্ষক। খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতি প্রচন্ড অনুরাগী একজন মানুষ, যাঁকে প্রায় প্রতিদিন খেলার মাঠে কিংবা টিচার্স কমন রুমে পাওয়া যেত। তিনি ছাত্র হিসেবে প্রচন্ড মেধাবী ছিলেন বলে শুনেছি এবং তখনও তাঁর ধ্যানজ্ঞান খেলাধুলা ক্রেন্দ্রিক আবর্তিত ছিল। জনমুখে কথিত আছে, তিনি কমিউনিটি মেডিসিনে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করে আমাদের মেডিকেলে যোগদান করেছিলেন, কারণ এখানে খেলার মাঠ আছে এবং তিনি ক্লাসের পর অফুরন্ত অবসর সময় পাবেন। অর্থাৎ এখান থেকে আমরা জীবনের নির্ভেজাল, নিষ্কণ্টক, আত্মিক সুখ, হতাশামুক্ত, উচ্চাকাঙ্ক্ষামুক্ত, সহজ সরল জীবনবোধ শিখতে পারি।
তাঁর ছাত্রদের প্রতি বন্ধুসুলভ আচরণ তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে। তিনি খেলোয়াড় এবং সংস্কৃতিমনা ছাত্রদের প্রতিভার কদর করতেন। তাঁদের উৎসাহ উদ্দীপনা যোগাতেন। বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের সাথে খেলার আয়োজনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। তবে তিনি শিরোপা জিতার ব্যাপারে মরিয়া হয়ে উঠতেন, যে কোন মূল্যে। হঠাৎ মাঠে ক্ষেপে যেতেও দেখেছি, প্রচুর পরিশ্রমী মানুষ। ছাত্ররা যেন পিছিয়ে না পড়ে সেই দিকে নজর রাখতেন, পড়ালেখায় উৎসাহ দিতেন। এক কথায় ব্যালেন্স করার ব্যাপারটি শিখাতে চেষ্টা করতেন।
যে কোন ছাত্র তাদের সমস্যা তার রুমে গিয়ে কিংবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলতে পারতো। একজন শিক্ষকের জন্য এটি একটি অনন্য গুণ বলে আমি মনে করি। তিনি তাদের কাউন্সেলিং করতেন, সাহস যোগাতেন, বুস্ট আপ করতেন। আমার সাথে উনার ব্যক্তিগত সম্পর্ক কখনও গড়ে উঠেনি, ৪র্থ বর্ষে আমার পেটের যক্ষ্মা ধরা পরে। স্যার আমাকে বর্ণনাতীত সাহায্য করেছিলেন যেভাবে পেরেছেন।
পরবর্তীতে তিনি আমাকে মেডিকেলের ইন্টার্ন জীবনের শেষ ৪৯ দিন, হাসপাতালের সহকারী পরিচালকের গুরুত্বপূর্ণ কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্রায় প্রতিদিন ডেকে ডেকে আমার বাঁচতে না চাওয়ার প্রবণতাকে মাথা থেকে বের করতে- যেভাবে কাউন্সেলিং করেছেন, তা অনস্বীকার্য। তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তব সত্য কথা বলেছিলেন, যা আমি আমার অনুজদের বলতে চাই। তিনি বলেছিলেন,
“এই ৪৯ দিন একটু যদি কষ্ট কর। তুমি যেদিন ক্যাম্পাস ত্যাগ করবে, ঠিক তখন তোমার মাথা সমস্ত চাপমুক্ত হবে। এখান থেকে যাওয়ার পর তুমি আবার নতুন করে বাঁচতে চাইবে।”
তাঁর এই কথার মত সত্য আর একটিও নয়। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র লিখেছেন,
“অতীত মুছে ফেলার শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে স্থান পাল্টানো। “
সত্যি গত ৩ বছর আমার শুধু বাঁচতেই ইচ্ছে হচ্ছে। তাই হতাশাগ্রস্ত অনুজদের বলব,
“একটু ধৈর্য ধরে কাউন্সেলিং এর উপর মনোযোগ দিতে। একবার বের হয়ে গেলে সত্যি সত্যি এসব আর মাথায় থাকে না। বাঁচতে ইচ্ছে হয়। একটাই জীবন, আর একবারই আসা যায়। চলে গেলে আর আসা যাবে না।”
স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ কখনো লিখে প্রকাশ করা সম্ভব না। তিনি মেডিকেলের অনেক পিছিয়ে পড়া ভাইদের কাউন্সেলিং করতেন, মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনতেন, সমাধান করার চেষ্টা করতেন। আবার আন্তঃব্যাচ গণ্ডগোলগুলোও সমাধান করতেন খুব টেকনিকালি।
তিনি পড়ালেখা নিয়ে কখনো কোন চাপ দিতেন না। পরীক্ষায় তেমন ফেলও করাতেন না, টার্গেট করে রাখার প্রশ্নই ছিল না।
এবার আসি তাঁর ছাত্রপ্রেমী গুণ বিশ্লেষণে। আমাদের দেশের প্রিন্সিপাল কিংবা ডিরেক্টররা বেশিরভাগই খুব কড়া প্রকৃতির। কোন এক অদৃশ্য কারণে তারা কখনো ছাত্রদের আপন করেন না, আর তাই ছাত্ররাও তাদের মনে তাকে জায়গা দেয় না। ব্যতিক্রম পরম শ্রদ্ধেয় ফাদার বেঞ্জামিন কোস্তা। ব্যতিক্রম কখনো উদাহরণ হয় না, তাই তাঁর কথা আমি শেষে উল্লেখ করব। আমাদের প্রিন্সিপাল স্যারও খুব কড়া ছিলেন, তবে সেটি আমার আলোচ্য বিষয় নয়। বিভিন্ন মিটিং এ তিনি ছাত্রদের উপর ক্ষেপে গেলে, ববি স্যারকে আমি দ্বিধাহীন বলিষ্ঠ কন্ঠে চিরদিন ছাত্রের পক্ষ নিয়ে কথা বলতে দেখেছি (তখন পর্যন্ত)। তাই এই গুণটিও স্যারের অনন্য। তিনি ছাত্রদের অন্তরের গহীনে জায়গা করে নিয়েছিলেন।
ববি স্যার অতিথিপরায়ণ ছিলেন। কলেজের প্রাক্তন ছাত্ররা যখনই পুনর্মিলনীতে আসতেন, তাদের অনেককে তিনি বাসায় দাওয়াত করে খাওয়াতেন।
পরিশেষে পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব ও আদর্শ গুরু ফাদার বেঞ্জামিন কোস্তাকে স্মরণ না করলে আমার লিখালিখি সর্বদা অপূর্ণ মনে হয়। কালজয়ী চরিত্র চিরকাল অমর থাকেন; যতদিন পৃথিবী বাঁচে তাঁরাও বেঁচে থাকেন অন্তরে, মননে, কাজকর্মে, প্রতিটি নতুন সৃষ্টির মাঝে। উনার মত মানুষ ও অধ্যক্ষ শতাব্দীতে একবারই আসেন হয়তো। যাকে খুব বেশি দরকার মেডিকেলে, যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত বিষণ্ণতায় ভুগে। উনার মত কেউ থাকলে হয়তো কেউ বছরের পর বছর পিছিয়ে পড়বে না কিংবা পড়লেও আবার উঠে দাঁড়িয়ে অদম্য শক্তিতে দুর্গম পথটি অনায়াসে হাসিমুখে শেষ করতে পারবে। উনাকে ক্লোন করে মেডিকেলগুলোতে যদি পাঠানো যেত, হয়তো মেডিকেলগুলোয় টার্গেট করে বছরের পর বছর ডিফলটার বানানোর অভিশাপমুক্ত হত। শারীরিক মৃত্যু কিংবা মানসিক মৃত্যু, দুটোই কিন্তু মৃত্যু।
আমি যখন রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে ক্লাস থ্রি তে পড়তাম, আমার প্রতিষ্ঠানের তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন প্রতিভাবান একজন ছাত্র ছিলেন এবং অসাধারণ বিতর্ক করতেন। তিনি কলেজ প্রিফেক্ট ছিলেন। আমরা সবাই বড় হয়ে উনার মত হতে চাইতাম। মেডিকেল কলেজে প্রথম বর্ষে এসে তাকে আমার মেডিকেলে ডিফলটার হিসেবে দেখতে পাই। আমি ডাক্তার হয়ে গেছি, তিনি তখনও একই অভিশাপে ছিলেন। পরবর্তীতে ঝরে পরেন। তিনি জীবন্মৃত ছিলেন, তার মৃত্যুটি ছিল মানসিক মৃত্যু। এরকম বহু উদাহরণ সব মেডিকেলে আছে। তাই ফাদারের মত পিতা ও গুরু আজ খুব বেশি দরকার যাকে ছাত্ররা আজও ভুলতে পারে না, অকৃত্রিমভাবে ভালবাসে। তিনি বলতেন,
“আমি চাই না তোমরা এ প্লাস পাও, আমি চাই তোমরা ভাল মানুষ হও। আমি চাই না আমার কলেজ এক নম্বর হোক, আমি চাই দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান একসাথে এক নম্বর হোক, তবেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।”
আমার আজকের লিখার উদ্দেশ্য-
আমার অনুজরা যখন একদিন দায়িত্ব পাবে, ছাত্রদের ভালবাসা যেন অর্জন করতে পারে। তাদের যেন আপন করতে পারে। তারা যেন তাদের সব সমস্যা বলতে পারে নিঃসংকোচে; যেন আর একটিও মানসিক বা শারীরিক মৃত্যু না ঘটে।