মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ভুয়া প্রশ্নপত্র বিক্রি করে শত কোটি টাকা হাতানোর টার্গেট নিয়ে সংঘবদ্ধ একটি প্রতারক চক্র নানা কৌশলী ছক এঁটেছে। এ মিশনের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে এরইমধ্যে তারা প্রশ্ন ফাঁসের গুজব ছড়াতে শুরু করেছে। আর এ ফাঁদে পা দিয়ে মেডিকেলে ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীদের অনেকেই এখন পরীক্ষার প্রস্তুতি ফেলে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র জোগাড়ের নেশায় মেতেছে। তাদের সঙ্গে বেশকিছু অভিভাবকও তাল মিলিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
প্রতারণার ফাঁদে পা দেয়া বেশ কয়েকজন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শতভাগ ‘কমন’ পড়ার নিশ্চয়তা দিয়ে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের মূল্য ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা হাঁকা হচ্ছে। কেউ কেউ আবার এর চেয়েও বেশি দাম চাচ্ছে। প্রতারকচক্রের সদস্যরা তাদের সরবরাহকৃত প্রশ্নের সঙ্গে পরীক্ষার হলের প্রশ্নের কোনো ধরনের গড়মিল থাকলে পুরো টাকা ফেরত দেয়ারও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। অনেকে আবার আরও একধাপ এগিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের পর টাকা পরিশোধের সুযোগ দেয়ার কথা বলছে। তবে এজন্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর এসএসসি ও এইচএসসির সার্টিফিকেট তাদের কাছে জমা রাখার শর্তজুড়ে দিচ্ছে।
তবে কথিত ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্র কারা, কখন, কার কাছে পেঁৗছে দেবে এবং এর বিনিময় মূল্যই বা তারা কীভাবে গ্রহণ করবে_ সে ব্যাপারে শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবকদের কেউ কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেনি। এ ছাড়া প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে দেশব্যাপী কঠোর গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে এ চক্র নিজেদের রক্ষা করে কথিত প্রশ্ন কীভাবে শিক্ষার্থীদের সরবরাহ
করবে সে ব্যাপারেও সুস্পষ্টভাবে কিছু জানা যায়নি। তবে প্রলুব্ধ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কারো কারো ধারণা, ই-মেইল কিংবা অনলাইনের কোনো মাধ্যমে এ প্রশ্নপত্র পরীক্ষার আগের রাতে তাদের হাতে পেঁৗছে দেয়া হবে। এ অপতৎপরতার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীদের দুই-তিনটি কোচিং সেন্টার জড়িত থাকতে পারে বলেও সন্দেহ করছেন অনেকে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা জানান, গত বছর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার ঘটনাকে পুঁজি করে সংঘবদ্ধ একাধিক চক্র এ প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে। আর এ কাজে তারা অত্যন্ত সুক্ষ্ম কৌশলে মেডিকেলে ভর্তিচ্ছুকদেরই ব্যবহার করছে। প্রতারক চক্র সুবিধাজনক একজন শিক্ষার্থীকে বেছে নিয়ে তাকে বিনামূল্যে প্রশ্নপত্র সরবরাহ করার প্রলোভন দেখিয়ে তার মাধ্যমেই ‘শিকার’ ধরছে। এ ছাড়া তারা অতিলোভী বেশকিছু অভিভাবককেও এ ফাঁদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা চালাচ্ছে। পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র মিলে যাওয়ার পর টাকা পরিশোধের সুযোগ দেয়ার বিষয়টিও বড় ধরনের ফাঁদ বলে মনে করেন তিনি।
ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, দু-একজনকে পরীক্ষার পর টাকা দেয়ার সুযোগ দিয়ে প্রতারক চক্র তাদের আস্থার ভিত তৈরি করে হাজার হাজার পরীক্ষার্থীকে প্রতারণার জালে ফেলতে চাইছে। যার বেশকিছু নমুনা এরই মধ্যে হাতে তারা পেয়েছে। এসব তথ্যের সূত্র ধরে গোটা চক্রকে জালে তোলার চেষ্টা চলছে বলে এ গোয়েন্দা কর্মকর্তা দাবি করেন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) শেখ নাজমূল আলম যায়যায়দিনকে বলেন, ‘মেডিকেল ভর্তির প্রশ্ন বেচে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিতে বিশেষ চক্রের তৎপর হয়ে ওঠার তথ্য আমাদের কাছেও আছে। তবে এ চক্রটি শতভাগ প্রতারক। তাদের ধরতে কয়েকটি টিম মাঠে নেমেছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার সন্দেহভাজন ১১টি কোচিং সেন্টার এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অর্ধশতাধিক কর্মকর্তার ওপর কঠোর নজর রাখা হচ্ছে। পাশাপাশি তাদের ঘিরে নানা কৌশলী ফাঁদ পাতা হয়েছে।
এদিকে প্রতারকচক্র যাতে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ যে কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কথিত ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্র সরবরাহ করতে না পারে এজন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিটিআরসি অনলাইনে সার্বক্ষণিক সতর্ক দৃষ্টি রাখার উদ্যোগ নিয়েছে। এ ধরনের কোনো তৎপরতা চালানোর সঙ্গে সঙ্গে বিটিআরসি ওই আইডি তাৎক্ষণিক বন্ধ করে দেবে। একই সঙ্গে তারা ওই ‘ডোমিন’ চিহ্নিত করে বিষয়টি দ্রুত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত করবে। যাতে এ চক্রের বিরুদ্ধে সহজেই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়।
পুলিশের দায়িত্বশীল এক সূত্রে জানা গেছে, প্রতারক চক্রকে গ্রেপ্তারে এরই মধ্যে মেডিকেল পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকের ছদ্মবেশে বিপুলসংখ্যক গোয়েন্দা মাঠে নেমেছে। তারা কথিত ফাঁস হওয়া প্রশ্ন কেনার নামে এ চক্রের সদস্যদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে।
তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করে বলেন, মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেউ যদি প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুজব ছড়িয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে অথবা এর মাধ্যমে ফায়দা লোটার চেষ্টা করে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মেডিকেলের ভর্তি কোচিংকে কেন্দ্র করে পরীক্ষার সময় প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুজবসহ নানা ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি হয় জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, শুধু এ কারণেই মেডিকেল ভর্তি কোচিং সেন্টার উঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন হলে এ ধরনের গুজব বন্ধ হবে বলে আশা করেন মন্ত্রী।
এদিকে মন্ত্রী-আমলা ও গোয়েন্দারা প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টিকে স্রেফ গুজব এবং প্রতারণার ফাঁদ বলে দাবি করলেও তাদের কথায় আস্থা রাখতে পারছেন না অনেকেই। বিশেষ করে গত বছরের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা সম্পর্কে যারা খোঁজ-খবর রেখেছেন তাদের অনেকেই জেনে-বুঝেও ‘প্রতারণার’ ফাঁদে পা দেয়ার জন্য মুখিয়ে রয়েছেন।
রাজধানীর শান্তিনগরের মেডিকো কোচিং সেন্টারে মেয়ের সঙ্গে আসা তাহমিনা রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘প্রতিবছরই তো মন্ত্রীরা এমন দাবি করেন। কিন্তু পরীক্ষার পর তো ফাঁসকৃত প্রশ্ন হুবহু মিলে গেছে। তখন তারা তদন্ত কমিটি করেই দায় সারেন। আর আমাদের মেধাবী সন্তানরা আক্ষেপ আর হতাশায় নিজের চুল ছিঁড়ে।’
মধ্যবিত্ত সংসারের গৃহিণী তাহমিনা জানান, সোর্স পেলে তিনি নিজেও মেয়ের জন্য এ প্রশ্ন কিনতে প্রস্তুত আছেন। কারণ প্রশ্ন ফাঁস হলে তার মেধাবী সন্তানও ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র হাতে পাওয়া নিম্নমানের শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকতে পারবে না।
তাহমিনা রহমানের মতো অনেকটা একই সুরে কথা বলেন মেডিকোতে কোচিং করতে আসা বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। তাদের দাবি, প্রশ্ন ফাঁসের গুজব আর প্রতারণা ঠেকাতে আগে সরকারকে আস্থাশীল হতে হবে। তা না হলে এ জোয়ার থেকে কাউকে ঠেকানো যাবে না।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদরা বলেন, আস্থা ফিরিয়ে আনতে পুরো প্রক্রিয়াকে মানুষের কাছে আরও স্বচ্ছ করতে হবে। এজন্য জাতীয় কমিটিও করা যেতে পারে। তবে এই কমিটি কোনো প্রশ্ন দেখতে পারবে না। তারা পরীক্ষা মনিটরিং করবে।
এ ছাড়া শাস্তিহীনতাকেই প্রশ্ন ফাঁসের বড় কারণ বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা। তারা জানান, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকলে শাস্তি নূ্যনতম তিন বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদ-সহ অর্থদ-। পাবলিক পরীক্ষাসমূহ (অপরাধ) আইন ১৯৮০ এবং সংশোধনী ১৯৯২-এর চার নম্বর ধারায় স্পষ্ট করে এই শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো আইন প্রণয়নের পর পাবলিক, বিসিএসসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় শতাধিকবার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটলেও কোনো অপরাধীর এক মাস শাস্তিরও নজির নেই। কেলেঙ্কারির পর পরীক্ষা স্থগিত করে অন্তত ৩৪ বার তদন্ত কমিটি গঠন করে সংকট সমাধানের সুপারিশ করা হলেও আজ পর্যন্ত একটি সুপারিশও কার্যকর হয়নি। ফলে একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস শিক্ষার্থীদের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাগাতার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় সরকারের অনেক অর্জন ম্নান হতে বসেছে।
সূত্রঃ যায় যায় দিন।