ঈদ হোক, পূজা হোক, যেকোন দুর্যোগ হোক – এখন পর্যন্ত কোনদিন হাসপাতাল বন্ধ থাকে নি।
কথাটি ঢাকার বড় বড় আলিশান প্রাইভেট হাসপাতালের জন্য যেমন সত্য, ঠিক তেমনি থানা বা ইউনিয়ন পর্যায়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হাসপাতাল গুলোর জন্যও সত্য।
কেউ যদি আপনার সামনে কখনো বলে কোন ঈদে/পূজায় অমুক সরকারি হাসপাতালে কোন ডাক্তার ছিলো না, জেনে রাখুন তিনি মিথ্যাচার করছেন। তিনি যদি আপনার শ্রদ্ধেয় বাবাও হন তাও তিনি মিথ্যাচার করছেন! হাসপাতাল ফেলে রেখে ঈদ করতে যাবার মতো মানসিকতা বাংলাদেশের ডাক্তারদের কোন কালেই ছিল না, হবেও না।
চলে যান বাংলাদেশের যেকোন প্রান্তে আগামীকাল, সরকারি হাসপাতালে ঢুকুন, দেখুন ডাক্তার খুঁজে পান কি না –
পাবেন, অবশ্যই পাবেন
এবার আসুন কতোগুলো পেছনের ফ্যাক্ট তুলে ধরিঃ
১. হাসপাতাল এ ডাক্তার থাকবেনই, কারন তার পেশাগত ঐতিহ্য তাকে আপনার-আমার মতো ঈদের দিনে প্রিয়জনের কাছে ছুটে যাওয়া থেকে বিরত রাখে।
২. হাসপাতালে মূলতঃ অভাব থাকে সেবিকা, ওয়ার্ড বয়, ওটি বয়, ব্রাদার এবং অন্যান্য কর্মচারীর।
কারন কি? কারন ডাক্তারদের চেয়ে এদের ইউনিয়নের জোর অনেক বেশী, প্রশাসনে এমন কোন বাপের ব্যাটা নেই যে ঈদের দিনে এদের সবাইকে হাসপাতালে উপস্থিত রাখতে পারে।
৩. হাসপাতালে ফ্রি ঔষধ থাকবে এবং তা পড়ে পড়ে নষ্ট হবে কারন যিনি বিতরণ করবেন সেই ফার্মাসিস্ট বাবু থাকবেন না
৪. প্রতিবছরই সরকার থেকে বিশেষ প্রজ্ঞাপন জারি হয় যে ঈদের আগে স্বাস্থ্য বিভাগের কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী যেন ঈদে কর্মস্থল ত্যাগ না করেন, অথচ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে একমাত্র ডাক্তাররাই এই আদেশকে মূলা দেখাতে পারেন না। আদেশ এলেও আমরা হাসপাতালে রোগী দেখি, আদেশ না এলেও আমরা রোগীদের জন্য আছি
৫. আমাদের মধ্যে আরেকটি ভ্রান্ত ধারণা আছে যে যারা হসপিটালগুলোতে এসময় ডিউটি করছে তারা একদম আনাড়ি ডাক্তার – তাদেরকে বলি, বাংলাদেশের হাসপাতাল গুলো এই সব ‘আনাড়ি’ ডাক্তাররাই টিকিয়ে রেখেছে। কয়জন অধ্যাপক কে দেখেছেন রাতের বেলা আপনার ডাকে সাড়া দিয়ে আপনার রোগী দেখতে ছুটে এসেছেন?
৬. আরো একটি ভাববার বিষয় হলোঃ ঈদের এই সময়টাতে জনবলের অভাবে ভেঙ্গে পড়ে হাসপাতাল গুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা, তাতে করে আর কিছু না হোক, আতঙ্কে থাকেন এই প্রিয়জন ফেলে এসে ডিউটি করা ডাক্তাররাই। জাতি হিসেবে আমাদের চেয়ে অকৃতজ্ঞ আর কেউ নাই, তার প্রমাণ মেলে হাসপাতালগুলোতে – সেই মানুষটা যিনি ৯৯ জন মানুষকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে বাড়ি পাঠালেন, তার হাতে একটি স্বাভাবিক মৃত্যুকেও বীর জনতা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারে না, ফলে আর কি? একলা নিরস্ত্র নিরীহ ডাক্তারই ধোলাই খায়, অবশ্য ইদানিং জনতার অনেক উন্নতি হয়েছে, এখন তারা মেয়ে ডাক্তারদের গায়েও হাত তোলেন!
আপনাদের কাছে আমাদের চাওয়ার কিছুই নাই, কারন আমরা যখন এই পেশায় এসেছি এই বিড়ম্বনা অসম্মানকেই আপন বলে ধরে নিয়েছি, তবু অনুরোধ থাকলোঃ
১. ঈদের দিন চলে আসেন, আপনার আশে পাশের কোন সরকারি হাসপাতালে, ঈদের ছুটি না কাটিয়ে যে ডাক্তার রোগীদের সেবা করছেন তার সাথে একটু সময় কাটিয়ে যান, এক কাপ চা খাওয়ানোর পয়সা পকেটে থাকবে আমাদের।
২. নেগেটিভ সংবাদ খুঁজে বেড়ানো একদল ইস্যুখোর সাংবাদিক কি লিখলো না লিখলো, তাই পড়ে ডাক্তারদের গালি দেবেন না, ঘটনা জানুন, নিজে দেখে আসুন – বিচার বুদ্ধি তো আপনার কম নেই, একজন যা লিখলো তাই আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে?
৩. বিপদে ধৈর্য্য ধরুন, আপনার কাছে আপনার স্ত্রী যতোখানি পরিচিত, আমাদের কাছে রোগ-শোক-মৃত্যু-জীবাণু-রক্ত তেমনিই পরিচিত, ধৈর্য্য ধরুন, সুচিকিতসায় আমাদের ডেডিকেশনের অভাব হবে না
৪. মাথা ঠান্ডা রাখুন, শুধুমাত্র ডাক্তারের উপর ভরসা রাখুন (ওষুধের দোকানদার, কোয়াক, পল্লী চিকিতসক, ডিপ্লোমা চিকিতসক, কবিরাজ, ওঝা – আপনার ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী আপনার চিকিতসক নির্বাচন করুন!!) আর একটু মনে রাখবেন, ধৈর্য্য, একজন ডাক্তারের, আপনার চেয়ে অনেক গুণ বেশী, কিন্তু রক্ত আপনার একারই গরম হয় না।
পবিত্র এই ঈদের দিনেও এক ঝাঁক ডাক্তার আপনার জন্য, আপনার প্রিয় মানুষটার জন্য, নিজের প্রিয় মানুষের কথা ভুলে হাসপাতালে থাকবেন – এই যাপিত জীবন অসামান্য গর্বের, আপনাদের পাশে থাকার এ সুযোগ অনেক প্রশান্তির
আমার নিজের কথা দিয়েই শেষ করিঃ
বাংলাদেশের কর্মপ্রাণ সংগ্রামী ত্যাগী একদল মেধাবী পেশাজীবীদের নিয়ে যে সমৃদ্ধ স্বাস্থ্যব্যবস্থা আমাদের পূর্বপুরুষেরা গড়ে রেখে গেছেন তার ধারা অব্যাহত থাকবে। মানুষের জন্য, জীবনের জন্য, আমাদের হাসপাতাল খোলা ছিলো, খোলা আছে –
এটাই আমাদের ভালোবাসার গল্প…
ডাঃ রাজীব দে সরকার
গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কম্পলেক্স, গোয়ালন্দ , রাজবাড়ী
এফ-১৫, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ