প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২২শে ডিসেম্বর ২০২০, মঙ্গলবার
লেখাঃ ডা. মো. মারুফুর রহমান
ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (চিকিৎসা জীবপ্রযুক্তি)
এমআইএস, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে যা সম্ভবত আরও অনেক বেশি সংক্রমণ ক্ষমতা সম্পন্ন অর্থাৎ আরও বেশি ছড়ানোর ক্ষমতা রাখে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন এই নতুন ভ্যারিয়েন্টটি আগের চেয়ে ৭০ শতাংশ বেশি সংক্রমণক্ষম। এই তথ্য বিবেচনায় পুরো যুক্তরাজ্যে ক্রিসমাসের এই উৎসবমুখর সময়েও ৪র্থ স্তরের লকডাউন আরোপ করা হয়েছে যার অর্থ হচ্ছে সব ধরনের “জরুরী সেবা” নয় এমন প্রতিষ্ঠান, বিনোদনকেন্দ্র বন্ধ থাকবে, এক বাড়ির লোক অন্য বাড়িতে যাবেনা তবে জরুরী প্রয়োজনে একজনের সাথে আরেকজন বাইরে পাবলিক প্লেসে দেখা করতে পারবে। ৪র্থ স্তরের লকডাউন ঘোষিত এলাকার বাসিন্দারা রাতে বাড়ির বাইরে থাকতে পারবেন না এবং বিদেশ ভ্রমণ করতে পারবেন না। ইতোমধ্যে, বিভিন্ন দেশ যুক্তরাজ্যে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও ফ্লাইট নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে এর মাঝে রয়েছে কানাডা, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, আয়ারল্যান্ড এবং বুলগেরিয়া। “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা”ও এ ব্যাপারে সতর্কবার্তা জারি করেছে এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
“কেন এই সতর্কতা?”
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে বিজ্ঞানীগণ করোনাভাইরাসের একটি নতুন বংশানুক্রমিক শাখা (ফাইলোজেনিক ক্লাস্টার) শনাক্ত করেছেন যা বিগত ৪ সপ্তাহ ধরে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই নতুন শাখাটির নামকরণ করা হয়েছে B.1.1.7 lineage এবং ধারণা করা হচ্ছে এটিই যুক্তরাজ্যে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক হারে সংক্রমণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এই শাখাটি প্রথম শনাক্ত হয় ২০ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের কেন্ট শহরে যা পরবর্তীতে লন্ডনে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়া শুরু করে। আজকের তারিখ পর্যন্ত (২১ ডিসেম্বর) GISAID জিনোম ডাটাবেজে এই নতুন ভ্যারিয়েন্টের ৫৬৪১৪টি ভাইরাস নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স জমা পড়েছে যার মাঝে যুক্তরাজ্য থেকেই জমা দেয়া হয়েছে ৪৭০৮১টি এবং ২য় সর্বোচ্চ এসেছে ডেনমার্ক থেকে ৫০২৯টি। এই নতুন শাখার ভাইরাসগুলোতে ১৪টি এমাইনো এসিড পরিবর্তনকারি এবং ৩টি ডিলিশন মিউটেশন রয়েছে। যুক্তরাজ্যের অন্যতম বৃহৎ করোনাভাইরাস টেস্টিং ল্যাব মিল্টন-কেয়েন্স ল্যাব এর প্রধান টনি কক্স এর একটি টুইটার বার্তা থেকে দেখা যায় নভেম্বরের শুরু থেকে এই নতুন ভ্যারিয়েন্টের ভাইরাস বৃদ্ধি পেতে শুরু করে এবং ডিসেম্বরে এসে এটিই অন্যান্য সকল ভ্যারিয়েন্টকে ছাপিয়ে যায় যা নতুন ভ্যারিয়েন্টটির অধিক সংক্রমণ প্রবণতাকেই নির্দেশ করে। উল্লেখ্য, নভেম্বর থেকেই মূলত যুক্তরাজ্যে অধিক হারে করোনাভাইরাস এর পুনঃসংক্রমণ শুরু হয়।
“কেন এই নতুন ভ্যারিয়েন্ট এবং এর মিউটেশনগুলো গুরুত্বপূর্ণ?”– এর ব্যাখ্যায় যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা বলেছেন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এর কথা। পরিবর্তনগুলোর মাঝে অন্যতম হচ্ছে N501Y মিউটেশন
যেটি করোনাভাইরাস এর স্পাইক প্রোটিনের রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইন (অর্থাৎ ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিনের যে অংশটি আমাদের দেহকোষের ACE2 রিসেপ্টর এর সাথে লেগে যাবার ফলে ভাইরাসটি কোষে প্রবেশ করে) এ ঘটেছে এবং দেখা গেছে এই পরিবর্তনটির ফলে ACE2 রিসেপ্টর এর সাথে ভাইরাসটির বন্ধন সক্ষমতা বেড়ে যায়। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনটি হলো, স্পাইক প্রোটিনের ৬০-৭০ পজিশনে ডিলিশন অর্থাৎ মুছে যাওয়া। এর ফলে ভাইরাসটি আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে ফাঁকি দেবার আরেকটা সুযোগ পায় বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই মিউটেশনটি ডেনমার্কে মিঙ্ক (এক ধরনের ইঁদুর জাতীয় প্রাণী) এর দেহে করোনাভাইরাস এর সংক্রমণ থেকে পাওয়া গেছে যার কারণে ডেনমার্ক প্রায় দেড় কোটি মিঙ্ক হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবি গুপ্ত জানিয়েছেন পরীক্ষাগারে এই মিউটেশনটির কারণে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রবণতা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেতে দেখা গেছে। তার দলের গবেষণায় আরও জানা গেছে যে, এই ডিলিশন এর কারণে কনভালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপিভিত্তিক চিকিৎসার কার্যকারীতা কমে যেতে পারে
(প্রি-প্রিন্ট লিংকঃ https://www.medrxiv.org/content/10.1101/2020.12.05.20241927v2.full.pdf)।
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ মিউটেশনটি হচ্ছে P681H যেটি ঘটেছে ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিনের ফিউরিন ক্লিভেজ সাইট নামের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। এই জায়গাটি মানুষের দেহকোষের সাথে লেগে যাবার পর করোনাভাইরাসকে কোষের ভেতরে প্রবেশ করতে সুবিধা প্রদান করে। ধারণা করা হচ্ছে এই মিউটেনশটির কারনে সুবিধাটি আরও বেড়ে যেতে পারে। উল্লেখ্য, এই মিউটেশনগুলো আলাদা আলাদাভাবে আগেও দেখা গেছে তবে একসাথে এই প্রথম। P681H এর মত একই স্থানে আরেকটি মিউটেশন P681R বাংলাদেশের কিছু নমুনাতেও দেখা গেছে বিসিএসএইএর গত মাসের জিনোম সিকোয়েন্স তথ্য অনুসারে।
“কি কারণে এই মিউটেশনগুলো একসাথে ঘটে নতুন এই অধিক সংক্রামক ভ্যারিয়েন্টের জন্ম হলো?”– এর ব্যাখ্যায় বিজ্ঞানীরা বলেছেন, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন (ইমিউনো-কম্প্রোমাইজড) রোগীরা দীর্ঘদিন কোভিড-১৯ রোগে ভোগেন এবং তাদের দেহে ২-৪ মাস পর্যন্ত করোনাভাইরাস পাওয়া যায়। এইসব রোগীদের সাধারণত কনভালেসেন্ট প্লাজমা এবং রেমডিসিভির প্রয়োগ করে চিকিৎসা করা হয়। দেখা গেছে এসব ক্ষেত্রে প্রাপ্ত ভাইরাস জিনোমে উচ্চ হারে মিউটেশন, ডিলিশন ইত্যাদি পরিবর্তন ঘটে। এছাড়াও উচ্চ ভাইরাল লোড আছে এমন রোগীদের প্লাজমা থেরাপি দেবার ফলে রোগী থেকে রোগীতে প্রাপ্ত ভাইরাস জিনোমের মাঝে বেশি পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। প্লাজমা থেরাপির এন্টিবডি দীর্ঘদিন ধরে আক্রান্ত ইমিউনোকম্প্রোমাইজড রোগীদের শরীরে অবস্থিত ভাইরাসের উপর বিশেষ মিউটেশন প্রেশার তৈরি করতে পারে যার কারনে এই এন্টিবডি ফাকি দিয়ে বেঁচে থাকা ও সংক্রমণ চালিয়ে যাবার মত মিউটেশন অর্জিত হতে পারে। তাই বিজ্ঞানীরা ধারনা করছেন সম্ভবত দীর্ঘ মেয়াদে আক্রান্ত এসব রোগীদের থেকেই এই নতুন ভ্যারিয়েন্টটি তৈরি হয়েছে।
তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুসারে নতুন এই প্রকরণটি অধিক সংক্রমণ ক্ষমতা সম্পন্ন হলেও রোগের তীব্রতা বা মৃত্যুর ক্ষেত্রে এই মিউটেশনগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে এখনও জানা যায় নি। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার ক্ষেত্রেও খুব বেশি পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই কেননা কেননা ভ্যাকসিনগুলো করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের একাধিক অংশকে লক্ষ্য করে প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে সংক্রমণ বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে এবং হাসপাতালে অতিরিক্ত রোগীর চাপ তৈরি হতে পারে বিবেচনায় ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্যে শক্ত লকডাউন শর্ত আরোপ করা হয়েছে এবং নিকটবর্তী দেশগুলো যুক্তরাজ্যে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এ বিষয়টি বিবেচনায় রাখা উচিত কেননা ফ্লাইট চালু থাকার কারণে বাংলাদেশ থেকে প্রচুর যাত্রী যুক্তরাজ্যে যাচ্ছেন এবং সেখান থেকে দেশে আসছেন। দেশে এ মুহুর্তে শক্ত লকডাউন শর্ত না থাকায় এবং আমাদের জনসংখ্যা ও ঘনবসতি বিবেচনায় করোনাভাইরাসের এই নতুন প্রকরণটি দেশে আসলে আমাদের দেশে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হঠাৎ করে অনেক বেড়ে যেতে পারে। তাই আমি মনি করি আমাদের এখনি এ ব্যাপারে সতর্ক অবস্থানে যাওয়া উচিত এবং বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে দ্রুতই যুক্তরাজ্যের সাথে সকল বিমান যোগাযোগ আপাতত স্থগিত করা উচিত। ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত এ ধরনের সতর্কতার কোন বিকল্প নেই।