৩রা ফেব্রুয়ারি,২০২০
সম্প্রতি নোভেল করোনাভাইরাস নিয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া আতঙ্কে যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশ চীনের সঙ্গে যোগাযোগ আপাতত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই নীরবে প্রাণ হরণ করছে আরেকটি ভাইরাস। যা কিনা রয়ে গিয়েছে গণমাধ্যমের আলোচনার বাইরে। বলা বাহুল্য, এ ভাইরাসে এরই মধ্যে ১৯ মিলিয়ন মার্কিন আক্রান্ত হয়েছেন। চলতি ফ্লু মৌসুমেই মারা গিয়েছেন প্রায় ১০,০০০ জন মার্কিন নাগরিক। অবশ্য নতুন কোনো মহামারী নয়, এটি সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা! আশঙ্কা করা হচ্ছে , লক্ষণ অনুযায়ী চীনের নতুন করোনাভাইরাস ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস পরিবারেরই হতে পারে।
২০১৯-২০ ফ্লু মৌসুম (শরৎ ও শীতকাল) যুক্তরাষ্ট্রে এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দেশটির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস এমন পূর্বাভাসই দিয়েছে। সংস্থাটির হিসাবে, এ মৌসুমে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ১ লাখ ৮০ হাজার মানুষ ফ্লুজনিত জটিলতা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ সংখ্যা দ্রুতই আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছ। বেশি পরিচিত হওয়ার কারণেই এ রোগের ক্রমেই প্রাণঘাতী হয়ে ওঠার স্বভাবটি সবার দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে বলে জানান আমেরিকান একাডেমি অব ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান বোর্ডের পরিচালক ডা. মার্গোট স্যাভয়। টেম্পল ইউনিভার্সিটির লুইস কাৎজ স্কুল অব মেডিসিনের ফ্যামিলি অ্যান্ড কমিউনিটি মেডিসিনের চেয়ারম্যান ডা. মার্গোট বলেন, “শীতকালেই আমরা বেশি ভাইরাসজনিত স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়ি। এ কারণে একটি প্রবণতা দেখা যায় যে, আমরা সব সমস্যাকেই সাধারণ ঠাণ্ডা লাগা বলে ভেবে বসি। ইনফ্লুয়েঞ্জা যে কতটা মারাত্মক হতে পারে সেটি আমরা ভুলে যাই। ”
স্যাভয় বলেন, ” একেবারে কম করে ধরলেও প্রতি বছর ইনফ্লুয়েঞ্জায় মৃত্যু বাড়ছে। সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোলের (সিডিসি) পূর্বাভাস অনুযায়ী, অদূর ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রে শুধু ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর গড়ে কমপক্ষে ১২ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করবে। যেখানে ২০১৭-১৮ ফ্লু মৌসুমে প্রায় ৬১ হাজার মানুষ মারা গিয়েছে, আক্রান্ত হয়েছে ৪৫ মিলিয়ন। চলতি ২০১৯-২০ মৌসুমে এখন পর্যন্ত ১৯ মিলিয়ন মানুষ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গিয়েছে ১০,০০০ জন। এর মধ্যে কমপক্ষে ৬৮টি শিশু রয়েছে।
সিডিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, টানা ১১ সপ্তাহ ধরে ফ্লু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। সামনে আরো কয়েক সপ্তাহ এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকবে।
স্যাভয় আরো বলেন,” চীনের নতুন করোনাভাইরাসের আতঙ্ক যুক্তরাষ্ট্রের এই ফ্লুর ভয়াবহতাকে দৃষ্টির আড়ালে নিয়ে যেতে পারে। মানুষ ফ্লু নিয়ে ভয় পায় না কারণ স্বাস্থ্য সেবাদাতারা সবসময় এটিকে ‘নিয়ন্ত্রণে আছে’ বলে দেখান। তিনি আরো বলেন, আমরা অজানাকে ভয় পাই। এ কারণে নতুন ও সম্প্রসারমান সংক্রমণ নিয়ে আমাদের মনোযোগ বেশি, সে সম্পর্কে বেশি তথ্য পেতে চাই। কিন্তু আসল কথা হলো, কোনটি সত্যিকার অর্থে আমাদের জন্য হুমকি আর কোনটা নয়, এটা তাৎক্ষণিকভাবে বলা মুশকিল। এ কারণেই আমরা যা নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি- হয়তো সেটি আতঙ্কিত হওয়ার মতো বিষয়ই নয়। ”
ফ্লু কীভাবে প্রাণঘাতী হতে পারে সেটির ব্যাখ্যা দিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটার মেডিকেল স্কুলের শিশুরোগ বিভাগের অতিরিক্ত সহকারী অধ্যাপক ডা. নাথান চমিলো। তিনি বলেন, “সাধারণ রোগ হওয়ার কারণে ফ্লুর ভয়াবহতাকে ছোট করে দেখা হয়। কিন্তু এ রোগটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া উচিত। ফ্লু যখন মারাত্মক আকার ধারণ করে তখন এটি কিন্তু আর সাধারণ অসুস্থতা থাকে না, ডেকে আনতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি।
তিনি আরো বলেন, “ফ্লু খু্বই বিপজ্জনক রূপ নিতে পারে কারণ এর ফলে দ্বিতীয় ধাপের সংক্রমণ শুরু হয়। মূলত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে এটি হয়। ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস সংক্রমণ একসঙ্গে হলে ফ্লুর উপসর্গগুলো জটিল রূপ ধারণ করে। যাদের নিয়মিত রোগ-বালাই লেগে থাকে ফ্লু তাদের জন্য বেশি বিপজ্জনক। দুর্বল স্বাস্থ্যের লোকেরা ফ্লু আক্রান্ত হলে যেসব জটিলতা দেখা দিকে পারে এর মধ্যে- নিউমোনিয়া, হৃৎপিণ্ড ও মস্কিষ্কের প্রদাহ এবং কোনো প্রত্যঙ্গ (লিভার, কিডনি) বিকল হয়ে যাওয়া অন্যতম। এ ধরনের জটিলতায় মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
চমিলো জানান তিনি যেখানে কাজ করেন সে এলাকায় ফ্লু মৌসুমে অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। বিশেষ করে ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু ভাইরাসের (এইচ১এন১) প্রাদুর্ভাবের পর থেকে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক অনেক রোগীকে আইসিইউতে পর্যন্ত নিতে হচ্ছে।
কেন এই জটিলতা?
এ প্রশ্নে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাইরাস খুব রহস্যময় একটি জীবাণু। এ জীবাণু নিয়মিত পরিবর্তিত হয়, অব্যাহত মিউটেশন ঘটে। এ কারণেই একই প্রজাতির ভাইরাসের সংক্রমণ আগের সময়ের চেয়ে মারাত্মক হতে পারে। সবচেয়ে সমস্যাজনক দিক হলো, ভাইরাসের এ পরিবর্তনগুলো খুব সূক্ষ্ম ও সামান্য। এ প্রক্রিয়াকে বলে অ্যান্টিজেনিক ড্রিফ্ট। অর্থাৎ শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে বোকা বানানোর কৌশল। তবে ফ্লু ভ্যাকসিন এরপরও সাধারণত কাজ করে বলে জানান ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ক্যারোলাইনার স্কুল অব পাবলিক হেলথের সহকারী অধ্যাপক মেলিসা নোলান।
তবে ভাইরাস কখনো কখনো অভূতপূর্ব অ্যান্টিজেনিক শিফ্ট ঘটায়। তখন সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতি তৈরি হয়। সেই প্রজাতিকে প্রতিরোধ করার মতো কোনো ব্যবস্থা শরীরে থাকে না।ফলে ওই ভাইরাস তখন মারাত্মক আকার ধারণ করে। সোজা কথায়, মানবশরীর তার পরিচিত জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করে রাখে। ফলে সেসব জীবাণু শরীরে প্রবেশ করলেও ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু সম্পূর্ণ নতুন ধরনের জীবাণুর আক্রমণ হলে শরীর তাকে শনাক্ত করতেও ব্যর্থ হয়।
সিডিসি বলছে, চলতি ফ্লু মৌসুমে ভাইরাসের মধ্যে অ্যান্টিজেনিক শিফ্টের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তবে এর আগে এটি ঘটেছে। বিশেষ করে ২০০৯ সালে এইচ১এন১ ভাইরাসের ক্ষেত্রে এটি হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে শরীরে প্রতিরোধ ব্যবস্থা না থাকার কারণে ওই সময় মহামারী আকার ধারণ করেছিল।
তাহলে এ ধরনের জটিলতা থেকে বাঁচার উপায় কী?
ডা. স্যাভয় এবং চমিলো বলছেন, “একটিই উপায়- ফ্লুর ভ্যাক্সিন নেয়া। এর ফলে একেবারে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি না করা পর্যন্ত কোনো ভাইরাস আপনার শরীরের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারবে না।”
সিডিসির রিপোর্ট অনুযায়ী চলতি ফ্লু মৌসুমে ১৭৩ মিলিয়ন ভ্যাক্সিন প্রদান করা হয় তবে মার্কিনদের মধ্যে অনেকেরই ভ্যাক্সিন গ্রহণে অনিচ্ছা বা অবহেলার কথা উল্লেখ করেন তিনি। তাদের ভ্রান্ত ধারণা এতে বিশেষ কোনো উপকার হয় না যেখানে কিনা ভ্যাক্সিন গ্রহণে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ৬০% পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
তথ্যসূত্র: সিএনএন
নিজস্ব প্রতিবেদক/হৃদিতা রোশনী