#যে_কথা_হয়নি_বলা….
১….
আমার একটা অবজারভেশন আছে।অবজারভেশনটা বলি। অধিকাংশ বাঙালি দেশের গন্ডি পার হয়ে বিদেশে একটু থিতু হলেই তাদের মাঝে দুইটা জিনিস প্রকটভাবে দেখা দেয়। এক: দেশপ্রেম, দুই: ধার্মিক ভাব। আমি অবশ্য এর মাঝে তেমন দোষের কিছু দেখি না…..
যাই হোক, কাজের কথায় আসি। আমার এক বন্ধু যে কিনা একই সাথে স্মার্ট এবং লেডি কিলার, সে এদেশের পাঠ চুকিয়ে, তিন মেয়েকে ঘুরিয়ে, সবশেষে পারিবারিকভাবে ১১ বছর ছোট আরেক মেয়েকে বিয়ে করে ইটালীতে গিয়ে থিতু হলো। যেহেতু সে বাঙালি, কাজেই তার মাঝে দেশপ্রেম ও ধার্মিক ভাব জেগে উঠতে হবে। দুটোই জেগে উঠলো, ধার্মিক ভাবটা প্রকট করার জন্য আমার অলওয়েজ ক্লিন শেভড্ বন্ধু এক হাত লম্বা দাঁড়িও রাখলো।কথা-বার্তায়ও ধার্মিক ভাব চলে আসলো, যার চ্যটিং এ সবচেয়ে ভদ্র কথোপকথন শুরু হতো-‘হালার পো হালা’ দিয়ে, তার চ্যাট এখন শুরু হয় ‘সালাম’ দিয়ে আর ইতি টানে ‘জাযাকাল্লাহ খায়রান’ বলে….
একদিনকার কথা, মধ্যরাত্রিতে হঠাৎ বন্ধুর ঘুম ভাঙলো। আচমকা ঘুম ভাঙার কারণ বের হলো, আক্কেল দাঁত উঠছে, তারই তীব্র ব্যথা শুরু হয়েছে। ব্যথা যখন সহ্যের সীমা ছাড়ালো, তখন বন্ধু ও বন্ধুপত্নী মধ্যরাত্রে স্থানীয় এক ক্লিনিকের ইমার্জেন্সীতে পা রাখলেন….
ঝাড়া ৩০ মিনিট বসে থাকার পর ডেন্টিস্ট সাহেবের দেখা পাওয়া গেলো।কথোপকথন অনেকটা নিম্নরূপঃ
ডেন্টিস্টঃ তোমার আক্কেল দাঁতটা ফেলে দিতে হচ্ছে….
বন্ধুঃ(ভীত গলায়) মাবুদে এলাহী!… তোমাকে কত দিতে হবে?
ডেন্টিস্টঃ আমার চার্জ ৫০০ ইউরো…
বন্ধুঃ( বাংলায়) আস্তাগফিরুল্লাহ, এক দাঁত ফালাইতে ৪৫,০০০ টাকা চাইতেছো?…
ডেন্টিস্টঃ দুঃখিত, আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না…..
বন্ধুঃ ইয়ে…তোমার চার্জটা বেশী মনে হচ্ছে…
ডেন্টিস্টঃ এটা ইমার্জেন্সী চার্জ, কালকে রুটিন টাইমে আসতে পারো, ২৫০ ইউরোতে দাঁতটা ফেলে দিতে পারবো। তবে আমার কলসালটেশন ফি ৭০ ইউরো এখন পে করতে হবে…
মধ্যরাত্রিতে দাঁতের ব্যথা নিয়ে গাড়ি চালিয়ে বন্ধু ও বন্ধুপত্নী বাসায় ফিরছেন।তবে বন্ধুর মনের ব্যথা দাঁতের ব্যথাকে ছাড়িয়ে গেছে। নীরবতা ভেঙ্গে বন্ধু বলে উঠলোঃ
‘বুঝলা বউ, ইন দা ইয়ার 1993, ঢাকা মেডিকেলের তিন তলায় একবার দাঁত ফালাইছিলাম, সবমিলায়ে তিন ট্যাকা খরচ হইছিলো। যে দেশের লোকেরা তিন ট্যাকায় দাঁত ফালায়, তাগো কাছে শালারা এক দাঁত ফালাইতে ৪৫,০০০ ট্যাকা চায়। খবিসের ঘরের খবিস…..’
২….
বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছোট হাসপাতাল। রাত- ৯ টা। ইমার্জেন্সী দায়িত্বে এক মেডিকেল অফিসার। মাত্রই একটি রোগী দেখে তার ওয়েটিং রুমে ঢুকলেন। হ্যান্ড ওয়াশ করতে গিয়ে বেসিনের কাছে যেতেই তার মনে পড়লো এই কলে পানি আসেনা মাস দুই হলো, টয়লেটের লাইটটিও নষ্ট মাস তিনেক ধরে…
বাসা থেকে নিয়ে আসা খাবার পানি দিয়ে হাত-মুখ ধুলেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। ভ্যাপসা গরম চারদিকে, এরপরও জানালা বন্ধ করতে হলো, একটার পর একটা মশা ঢুকছে রুমে। দেশের সবচেয়ে মেধাবী গোষ্ঠীর লোক হয়েও Backbencher রা এখন তার সমতুল্য বেতন পায়, সিকিউরিটি নিয়ে মশাবিহীন এসি রুমে বসে থাকে, গায়ে যাতে ধূলো না লাগে তার নিমিত্তে সরকারী গাড়ীও পায়। আর তাকে এখন অজপাড়াগাঁয়ে ভ্যাপসা গরমে মশা মারতে হয়। বিচিত্র দেশ, বিচিত্র তার কাজকারবার…..
এমন সময় চিকিৎসক তার ওয়েটিং রুম থেকেই হাসপাতালের গেইটে একটি গাড়ী থামার শব্দ পেলেন, নতুন রোগী এসেছে। ইমার্জেন্সী রুমে রোগীকে শোয়ানোর সাথে সাথে চিকিৎসক রোগীকে দেখলেন। বাচ্চা একটা রোগীর খিঁচুনী চলছে, বাচ্চার সাথে ভিজিটর হিসেবে জনা দশেক লোক, দুজন মহিলা তারস্বরে কান্নাকাটি করছেন….
চিকিৎসক সাহেব দ্রুত বাচ্চাটিকে পাশ ফিরে শোয়ালেন(Recovery position), অক্সিজেন দেয়া স্টার্ট করলেন, কাগজে ডায়াজিপামের অ্যাম্পুল লিখে দিয়ে সেটা আনতে তাগাদা দিলেন….
ওষুধ আনতে দেয়াই চিকিৎসকের জন্য কাল হলো।হাসপাতালে নিয়ে আসার পরও আবার বাইরে থেকে ওষুধ কিনে আনতে হবে কেন? চিকিৎসক যতই বোঝান না কেন যে এই ওষুধের বরাদ্দ নেই, তাতে কোনো লাভ হলো না। তারা চিকিৎসকের দিকে তেড়ে এলেন….
যাই হোক, ওষুধ নিয়ে আসা হলো এবং সেটা প্রয়োগ করা হলো। মাঝের পুরো সময়টা রোগীর জনা দশেক লোক চিকিৎসক ও চিকিৎসক সহকারীর সাথে ষন্ডাগিরি চালিয়ে গেলেন, রোগী যদি কোনো কারণে মারা যায় তবে তাদেরকে মাটিতে পোঁতা হবে বলে হুঁশিয়ারিও দেয়া হলো। চিকিৎসক সাহেব বুঝতে পারলেন–অনেকটা ঢাল-তলোয়ারবিহীন এই অবস্থায় নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাকে ফাইট করতে হচ্ছে চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি কঠিনতম অবস্থার সাথে। অনেক সময় এই খিঁচুনী বন্ধ করতে বিভিন্ন রকমের ওষুধের প্রয়োজন হয়, সব প্রয়োগ করার পরও মৃত্যু হতে পারে….
চিকিৎসক সাহেবকে সাহায্য করার জন্য সৃষ্টিকর্তা বাদে আর কাউকে পাওয়া গেলো না। আশার কথা সৃষ্টিকর্তা সাহায্য করলেন, খিঁচুনী বন্ধ হলো। ইটালীর মত ডাক্তার আসতেই আধা ঘন্টা সময় লাগেনি, রোগী নিয়ে আসা থেকে শুরু করে সবকাজ সম্পন্ন করতে সবমিলিয়ে সময় লেগেছিলো ১০ মিনিট…
খিঁচুনী বন্ধ হবার সাথে সাথে চিকিৎসকের কথা না শুনেই তারা রোগী নিয়ে রওনা হলেন। সরকারী এন্ট্রি ফি না দিয়েই তারা চলে যান। চিকিৎসক নিজ পকেট থেকে দশ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করলেন, কেউ সেটা বুঝতে পারেনি….
৩….
যে দেশের স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের পরিমাণ মোট বাজেটের মাত্র ৪.০৪ শতাংশ, যে দেশে প্রতি লোকের স্বাস্থ্যের পেছনে দৈনিক ২ টাকা ২ পয়সা খরচ হয়, সে দেশে স্বাস্থ্য সেবা বলতে আক্ষরিক অর্থে কোনো কিছু থাকার কথা না। ঘটনা সেরকম ঘটেনি। নানা সীমাবদ্ধতা থাকার পরও এদেশের স্বাস্থ্যখাত সামনে এগিয়েছে। গর্ব করে প্রমাণসহ বলতে পারি, সারা পৃথিবী এদেশের হাতেগোণা যে দু’তিনটি সেক্টরের প্রশংসা করে তার একটি স্বাস্থ্যখাত….
আমি যে টাইপের লেখা লিখি সেগুলোকে কারো জন্য উৎসর্গ করা যায় কিনা সেটা আমার জানা নেই। আমি সাহিত্যের লোক না, নিয়মনীতি কম বুঝি।তবে কোনো কোনো সময় নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করলেও চলে, তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। দিনের পর দিন বঞ্চিত যে চিকিৎসকরা দীর্ঘশ্বাসকে সঙ্গী করে পর্দার আড়ালে থেকে এদেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবাকে বৈশ্বিক পর্যায়ে নিয়ে যাবার নিরন্তর চেষ্টায় লিপ্ত–আমার এই ক্ষুদ্র লেখাটি আজ তাদের জন্য উৎসর্গ করলাম…..
..
ডা. জামান অ্যালেক্স এর ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।