রক্তাক্ত সিলেটঃ একজন চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা

5

দুপুর সোয়া দুইটা বাজলেই আমার একটু একটু করে মেজাজ গরম হওয়া শুরু করে- যখন ডিরেক্টর অফিস থেকে ফোনে জানানো হলো যে মেডিকেল টিমের অংশ হিসেবে ৩টায় যেতে হবে বর্তমান ন্যাশনাল ক্রাইসিস সিলেটের শিববাড়িতে- মেজাজ পুরা খিচে গিয়েছিল। ‘বিবাহিত ব্যাচেলর’ আমরা দুই কসাই জামাই বৌ-র ২৪ ঘন্টার ভেতর মুলাকাত বলতে দুপুর ৩টা থেকে ৪টা। আর এর ভেতরেই যদি কোন কাজ পড়ে- সেটা যত ইমার্জেন্সিই হোক——। এর আগের দুই দিনই বাসায় পৌঁছেছি ভোর ৪ টায়।

যাই হোক- সাড়ে ৩টার দিকে আমরা ৩ চিকিৎসক আর একজন ব্রাদার মিলে গেলাম ঐখানে। যাদের রিলিভার হিসেবে গেলাম তারা বললেন যে, একশন মনে হয় শেষ- সকালে বিশাল আকারে এটাক হয়েছে। এম্বুলেন্স-এ বসে উৎসুক জনতার নানাবিধ কান্ড কীর্তি দেখে হাসাহাসি করলাম- খানিক পর পর পুলিশের দাবড়ানি খেয়ে একটু দূরে যায়- আবার জটলা পাকায়-৫ জন সেনা সদস্য মারা গিয়েছে- এক ব্যাটা আর এক বেটিরে মারতে ঢাকা থেইক্যা সেনাবাহিনী আনা লাগে-এমন আরও কাহিনী আর বিশাল বিশাল বিশ্লেষন শুনতে থাকলাম।

কিছুক্ষন পরেই গ্রেনেড এর শব্দ আর কয়েকশ রাউন্ড গুলির শব্দ- এত কাছ থেকে শুনছিলাম- একটু আতংকিততো হচ্ছিলামই। ড্রাইভার বলল যে, সকালে আমাদের গাড়ির খুব কাছ দিয়ে কয়েকটা গুলি গিয়েছে। ডিরেক্টর স্যারকে গালি দিতে লাগলাম- ইমার্জেন্সি টিম দিয়ে পাঠালেনই যখন একটু প্রটেকশন দিয়ে পাঠাতেন- আমরা যে রেঞ্জে ছিলাম সেখানে বুলেট প্রুফ জ্যাকেট ছাড়া মানুষ ছিলাম আমরা এই কয়েকজনই- এতোটাই কম দাম কসাইদের???

সন্ধ্যা হতেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে ‘মশা মারা কেরানি’ হয়ে গেলাম। কিছুক্ষন পরেই দেখলাম বিশাল এক সাংবাদিক গ্রুপকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে- একটু খুশি হলাম- হয়ত মিশন কমপ্লিটেড-প্রেস ব্রিফিং হলেই ফিরে যেতে পারব- আজাইরা বসে বসে এতোটাই বিরক্ত হচ্ছিলাম। সাংবাদিকরা ফিরে আসল- হঠাত করেই সন্ধ্যা ৭টার দিকে একটা বিকট শব্দ শুনলাম- মানুষের হট্টগোল শুরু হল – আতংকিত হলাম কারণ শব্দটা ঐ বাড়ি থেকে আসে নাই আসছে সেইফ জোন থেকে। একটু পরেই আবারও শব্দ- ভেতর থেকে দুইটা এম্বুলেন্স আসল- আমাদেরটাও এদের ফলো করল- রাস্তায় উঠার সময়ই দেখলাম রক্তের ছোপ ছোপ দাগ- রাস্তা থেকেই একজন আহতকে নিয়ে ছুটলাম মেডিকেলের দিকে।
ইমার্জেন্সিতে ঢুকতেই একের পর এক আহত ঢুকতে থাকল- ইমার্জেন্সি অফিসার ভাইয়াকে একটু সাহায্য করলাম। ইমার্জেন্সির ঝামেলা শেষে গেলাম সার্জারি ওয়ার্ডে- সেখানে কিছুক্ষন থেকে বেশি রোগী না দেখে ওটিতে দৌড় লাগালাম।

ওটি বি ব্লক- লোকে লোকারণ্য- সিনিয়র প্রফেসর, সার্জারির সকল স্পেশিয়ালিটির সকল স্যাররা, সকল ট্রেইনি, ইন্টার্ন এবং কয়েকজন স্টুডেন্ট, নার্স, ওয়ার্ড বয়- ১২টা ওটি টেবিলের সবগুলোতেই সবাই যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ৩ জন(একজন পুলিশ অফিসার ও একজন কমান্ডিং অফিসারসহ)- কার্ডিয়াক এরেস্টে(হার্ট বিট দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে- শ্বাস নিচ্ছে না)- এনেস্থেশিস্টরা সি পি আর(কার্ডিয়াক ম্যাসেজ) দিচ্ছেন একের পর এক- ঘেমে নেয়ে যাচ্ছেন সবাই- নার্সরা স্যালাইন ওপেন করতেছে- সার্জনরা অপারেশন করতেছেন- ওয়ার্ড বয়রা প্লাস্টার করতেছে- কয়েকজন এটেন্ডেন্ট ক্লিয়ার করতেছে- রক্ত আনা নেয়া করতেছে কয়েকজন। সবার মিলিত প্রচেষ্টায় প্রায় ঘন্টা খানেকের চেষ্টায় হার্ট আবার বিট দেয়া শুরু করল- এয়ার এম্বুল্যান্সে নিয়ে গেল সিএম এইচে একজনকে- আরেকজনকে অন্য ওটিতে নেয়া হল অপারেশনের জন্য।
ওটি এ ব্লকে দেখি ওখানেও একি অবস্থা- এখানেও একসাথে ৪ টেবিলেই চলছে রোগীকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা। সব স্যাররা ইতিমধ্যেই অপারেশন শুরু করে দিয়েছেন। সবার ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টায় বেশিরভাগই সুস্থ হয়ে অপারেশন রুম থেকে পোস্ট অপারেটিভ রুমে চলে যাচ্ছিল; নিচে ব্লাড ব্যাংক, সন্ধানী, মেডিসিন ক্লাবে সমানে সবাই প্রয়োজনীয় রক্ত দিতে লাগল- স্টুডেন্টরাও এসে তাদের সাধ্যমত সহযোগিতা করতে লাগল।

দুইজনকে নিয়ে এনেস্থেশিওলজিস্ট, সার্জন এবং বাকি সবাই খুব যুদ্ধ করছিল। অপারেশনের মধ্যেই কয়েকবারই কার্ডিয়াক এরেস্টে চলে যাচ্ছিল- আবার একই যুদ্ধ- একদিকে সিপিআর অন্যদিকে অপারেশন। রাত আড়াইটার সময় যখন ফিরে আসি- বিষণ্ণ সবাই-স্যাররাও বিমর্ষ- এতো এতো চেষ্টার পরেও কোন লাভ হলোনা- গত ৬ ঘন্টার এত্তো এত্তোগুলো মানুষের ক্লান্তিহীন চেষ্টাকে বৃথাই মনে হলো-নিহত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ সবার আত্মার সদগতি হোক

ক্লান্তি নিয়েই বাসায় ফিরলাম – কালকে আবার এই নরপিশাচরা হামলা করতে পারে- আবার সেই যুদ্ধ- কালকে আবার আমার ইউনিটেই এডমিশন – একটু ঘুমানো জরুরি।
……
ডাঃ অনুজ কান্তি দাশ

drferdous

5 thoughts on “রক্তাক্ত সিলেটঃ একজন চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

শহীদ চিকিৎসকদের নামে বিএসএমএমইউ'র বিভিন্ন স্থাপনার নামকরণের প্রস্তাব

Sun Mar 26 , 2017
গতকাল ২৫ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান খান স্যারের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, চিকিৎসা, গবেষণাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম, উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বপালনের দু’বছর পূর্তিতে ব্যক্তিগত মূল্যায়ন, ভবিষ্যত পরিকল্পনা, তৎকালীন আইপিজিএমআর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর, চিকিৎসকদের নিরাপত্তা, চিকিৎসা আইন, বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবার ইতিবাচক প্রচারে […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo