X

রোগীর স্মৃতিতে ডা. মইনউদ্দীন, রইবেন চিরসবুজ হয়ে

১৫ মে, ২০২০, শুক্রবার

শরীরটা আজ বেহায়া হয়ে উঠেছে। রাতে ঘুম হয় নি আমার। রোগী দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না একদম। কিন্তু যারা চিকিৎসার জন্য আসে দূর থেকে, তাদের দিকটাও ভাবতে হয়।

চিকিৎসক হিসেবে যৎকিঞ্চিত সুনাম পেলেও, রোগী হিসেবে বরাবরই দূর্নাম আমার।

“Doctors are the worst patients”

আমি আজকাল তার চেয়েও খারাপ। রক্তে গ্লুকোজটা বাড়ছে। ঘাড়ে ব্যথা হচ্ছিলো। সকাল থেকে তীব্র বৃষ্টি ও বজ্রপাত দেখলাম জানালায় বসে বসে।

রোগী আসা শুরু করেছেন। চেম্বারে যাই রুমে আসি। একটা টানা ঘুম দেবার যেই অভিপ্রায়, তখন আবার ডাক পড়লো।

গিয়ে দেখি রোগী একজন বয়স্কা নারী। চেয়ারে বসে আমার দিকে একটা ফাইল এগিয়ে দিলো। তার দিকে আমার চোখ নিবিষ্ট। আমার চোখগুলো কেমন ভিজে গেলো অনুভব করলাম।

রোগী বলে, “আপনি কান্না করছেন কেন?” রোগী তার অনুভূতি জানাচ্ছে আমাকে। “উনাকে দশ বছর ধরে দেখাতাম। অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। হাসি মুখে কথা বলতেন। মা ছাড়া কথা বলতেন না।” একবার বলেছিলেন, “আমাকে না পেলে আপনার বাড়ির কাছে আমার ছাত্র ডাঃ জোবায়ের আছে তাকে দেখাবেন।”

আমি চুপচাপ শুনছি। তাকিয়ে দেখি রোগীর চোখও ভিজা।

নাদামপুরের সবুজ গাঁয়ে ঘুমিয়ে গেছেন চিরনিদ্রায়। এই ঘুমিয়ে পড়ার আগে একটু ঘুমাতে চেয়েছিলেন শান্তিতে। কিন্তু তখন সেখানে পরিবেশ ছিলো না ঘুমানোর।

বলেছিলেন, “আমি দাঁড়িয়ে আছি। একটু ঘুমাতে পারলে আরাম হতো। বাসায় গেলে আরাম হতো। এখানে ঘুমানো ইম্পসিবল।”

বাঁচার আকুতি নিয়ে একটু আইসিইউতে যেতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, “তোমরা আমাকে ওসমানীর আইসিইউ তে নিয়ে যাও।”

কারো কাছে আকুলতা জানিয়ে বলেছেন, “আমার জন্য একটা আইসিইউ এম্বুলেন্স ম্যানেজ করা যায়না?”

জুনিয়র চিকিৎসকদের জন্য পিপিই বেশি দরকার বলে জানিয়েছিলেন। তারা বেশি এক্সপোজড।

বলেছিলেন, “আমি কাজ করছি পিপিই ছাড়া।”

এক বুক অভিমান, নীরব বেদনায় আহত নীল হৃদয় ও নীরব অশ্রুপাত করেই সিলেট থেকে ঢাকা গিয়েছিলেন নিজ উদ্যোগে নিজ ব্যবস্থায়।

ফিরে এসেছেন চিরচেনা শহরে নিথর দেহে।

বাংলাদেশের মানুষ আর কোন চিকিৎসক এর জন্য এমন অশ্রুসিক্ত হয়েছেন, আমার জানা নেই। কোন চিকিৎসক এর চিরবিদায়ে এমন হাহাকার করেছেন, এমন মাতম তুলেছেন আমি শুনি নি।

তাঁর প্রতি অবহেলা করে ভালোই করেছেন উনারা। জাতি চিনে গেলো একজন মানবিক সরল ডাক্তারকে, যে গরীবের ডাক্তার হয়ে উঠেছিলেন। যার জন্য অশ্রুসিক্ত হওয়াও গর্বের।

স্মৃতিগুলো বেদনা বাড়ায়। হাহাকার জাগায়। নীরবে দংশন করে বারবার।

ভালো থাকবেন গরীবের ডাক্তার প্রিয় মানুষ ডাঃ মঈনউদ্দিন স্যার। আমাদের দোয়ায় ও স্মৃতিতে আপনি উজ্জ্বল হয়ে আছেন, থাকবেন।

ডা. জোবায়ের আহমেদ

Platform:
Related Post