প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০, বৃহস্পতিবার
ডা. অনুজ কান্তি দাশ
সহকারি রেজিস্ট্রার, সার্জারি,
সিওমেকহা।
উদ্দেশ্যহীন কথাবার্তা, পড়ে সময় নষ্ট না করলেই ভাল!
আমি যে ওয়ার্ডে গত ৪ দিন ধরে ডিউটি করতেছি সেখানে গতকাল সকাল ৮ টায় রোগী ছিল ১১৩ জন, সাথে কেবিনে ৫ জন এবং প্রিজন সেলে ৪ জন। এই যে ওয়ার্ড, এখানে সরকারি হিসাবে রোগীর জন্যে নির্ধারিত বেড ৪০টি। ঠেলাঠেলি আর প্রশাসনের বদান্যতায় এর বাইরে আরও ৪০টি বেড করা হয়েছে। প্রতিজন রোগীর সাথে গড়ে ৩জন করে এটেন্ডেন্ট। ইন্টার্নসহ চিকিৎসক ৮ জন, নার্সিং স্টাফ ৩জন, ওয়ার্ড বয় ৩ জন, আনসার ১ জন। মনে করেন এই রুমের ভেতরে এমনও হতে পারে যে করোনা ভাইরাস একজন আরেকজনের সাথে কলিশন করে রুম ছাড়া করে দেয়। কারণ অন্য সব প্রতিষ্ঠানে থার্মাল স্ক্যান, স্বাস্থ্য বিধি মানামানির বালাই থাকলেও, এই রুমের ভেতর কোন বিধি মানামানি কোন সুযোগ নাই।
যাইহোক সকাল সোয়া আটটায় সকল পূর্ব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ওয়ার্ডে ঢুকি। ঢুকে ওয়ার্ড বয় আর আনসারদের বলি রোগীর লোকজন রুমের বাইরে বের করে দিতে। এই ১৫-২০ মিনিট চলে হাউ কাউ। কেউ বের হতে চায় না। যাই হোক, ২০মিনিট পরে গিয়ে দেখি ৫০% ক্লিয়ার হয়েছে। তারপর এবার আমার পালা, যেসব রোগীর সাহায্য প্রয়োজন তাদের একজন লোক রেখে বাকি সব রোগীর লোক বের হতে বলি- আমরা বললে বেশি কাজে দেয়; তারপরেও এখান থেকে ৫-১০% থাকে যারা কিছুতেই বের হবেনা। এদের বেশিরভাগই হলে সমাজের শিক্ষিত, সচেতন, ক্ষমতাধর নাগরিক। গোসসা দেখিয়ে আবার ডেস্কে ফেরত আসি বা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি বা উনাদের শিক্ষিত এবং ক্ষমতাধর হওয়া নিয়ে টিটকারি মারি। তারপরেও ২-৩ রোগী লোক থেকেই যায়- যাদের দৌড় আমার অনেক উপরে, তাই নিজের পশ্চাত বাঁচাতে উনাদের রেখেই রাউন্ড শুরু করি। একটা হ্যান্ড মাইকের খুব অভাব বোধ করি। হাসপাতাল নাকি সেনসিটিভ জায়গা- এখানে মাইক ব্যবহার করা যাবে না। গলার উপর অনেক অত্যাচার যায় – তার উপর এন ৯৫ মাস্ক। নাকের কার্টিলেজ নষ্ট হয়ে নাকের হাড্ডিতে স্ট্রেস ফ্র্যাকচার হয়ে গেছে কি না এতো দিনে কে জানে। যাই হোক, ৯ টার দিকে রাউন্ড শুরু করি।
১২০ জন রোগী দেখি – দেখতে দেখতে এক থেকে দেড় ঘন্টা চলে যায়। কারও পেটে ব্যথা, কেউ আসছে এক্সিডেন্ট করে, কেউ মারামারি করে, কারও বুকে টেটা ঢুকছে, প্রস্রাব আটকে গেছে, পায়খানা দিয়ে রক্ত পরে, পায়ে আলসার, শরীরে চাকা, হার্নিয়া, এপেন্ডিসাইটিস – একেক রোগীর একেক সমস্যা আবার একেকজনের একেকরকম হিস্টরি। রোগের ইতিহাস নেয়া হল একটা আর্ট- এই আর্টসের চর্চা করাতে করাতেই মেডিকেল সায়েন্সের ৮০ ভাগ পড়ালেখা শেষ হয়। তবে বেডের অতিরিক্ত এতো রোগী থাকলে এসব সায়েন্স আর্টস না হয়ে কমার্স হয়ে যায়! যার যার লাগবে ইন্টার্নদের সবকিছু বুঝাই দিয়ে একটু চেঞ্জিং রুমে গিয়ে মাস্ক খুলে শ্বাস নিয়ে আসি। এরপর শুরু হয়ে স্যারদের রাউন্ড। এবার সব রোগীদের হিস্টরি, পেট টিপে কি পাইলাম অথবা তার পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফল কি- মাঝে মাঝে কিছু ভুল হলে সেটা নিয়ে অনেক স্যার সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেন কোন স্যার আবার টিপ্পনিও মারেন- আমি তো ট্রেনিং করে আসলে বুড়া হয়ে গেছি! তবে একটা বিষয় আমি হিসাব মিলাতে পারি না- যে আমি বাসার বাজার করতে গেলে লিস্ট নিয়ে যাই আর মোবাইলে লিখে নিয়ে যাই- যেভাবেই যাই না কেন এমন কোন দিন হয় না যে ২-৩ টা আইটেম ভুলে না নিয়ে বাসায় ফিরছি- সে আমিই কি অবলীলায় এতোগুলো রোগীর প্রয়োজনীয় সবকিছু কিভাবে মনে রাখি, এই হিসাবে ভুল খুব কমই হয়।
এর মাঝে অনেক রোগীকে অপারেশনে পাঠানো, ফ্রেশ অর্ডার করা, প্রশাসনিক অফিসে স্যারদের তলবে যাওয়া, ঔষধ ইন্ডেন্ট করা, লাইট- ফ্যান ঠিক করানো, ইন্ডেন্ট চেক করা, কালকে ছুটি দিয়েছিলাম ৩৬ জন রোগী- এদের ছাড়পত্রে সই করা, এসব শেষ করে দুপুরে খেতে বাজে ৩-সাড়ে ৩ টা। এরপর আবার সন্ধ্যার পর আবার রাউন্ড- অপারেশন- চলছেই।
এখন এই ৪টার সময় একটু রিলাক্স করতে গিয়ে আর সন্ধ্যার পর অপারেশন থিয়েটারে যাবার প্রস্তুতি নিতে নিতে এগুলো কেন মাথায় আসল জানিনা- তবে ৫ বছর ধরে এই কাজ প্রতিদিন করতেছি (করোনার কারণে গত ৬ মাসে অবশ্য মাঝে কোয়ারেন্টিন পেয়েছি)। চাকরি জীবনের ৮ বছর অতিবাহিত হল- একই গ্রেডে একই ব্যস্ততায় কাটিয়ে দিলাম। প্রমোশন, প্রণোদনা- এগুলোতে যোগ্যতা থাকার পরেও একই অবস্থায় – তারপরেও চলছে গাড়ি- শ্বাস থামলে গাড়িও থামবে।