রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২০
অধ্যাপক ডা. মো: সোহাইলুল ইসলাম
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
“রানার রানার এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে? রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে?”
সুকান্তের কবিতার রানারের মত করোনার অসুস্থতার প্রলম্বিত লক্ষণ কিছু কিছু (১০-১২%) কোভিড আক্রান্ত রোগীদের আর কতকাল বয়ে বেড়াতে হবে, এই রহস্যময় রোগের শেষ কোথায়, তা চিকিৎসকরাও জানেন না। Long Covid নামক এই রোগের রয়েছে শরীরের বিভিন্ন সিস্টেমকে দীর্ঘ মেয়াদে এফেক্ট করার প্রবণতা, যা কোভিড-১৯ কে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছে এবং নোভেল প্যানডেমিক কে বুঝতে হলে long haulers এর কস্টকর অভিজ্ঞতার গল্পগুলো জানা প্রয়োজন। আমি মার্চ মাসে করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিলাম। ছয় মাস হয়ে গেল, আমি এখনো অসুস্থ।”শ্মশ্রু ক্লান্ত অবসন্ন চাহনিতে কথাগুলো বললেন চার্লি রাসেল। করোনা মহামারীর বিষাক্ত ছোঁয়া পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করার কিছুদিন আগেও সে ছিল একজন ২৭ বছরের টগবগে তরুণ। এখন সে “Post Covid illness” এ আক্রান্ত আনুমানিক ছয় লক্ষ রোগীর একজন। যে ক্লিনিকাল কন্ডিশন চিকিৎসা বিজ্ঞানীদরকে myalgic encephalomyelitis (ME) বা chronic fatigue syndrome নামক একধরনের নিউরোলজিকাল সমস্যার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করছে।
চার্লি রাসেল নাট্যকলায় প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত একজন ফটোগ্রাফার। কোভিডে আক্রান্ত হবার পর আজ একশ আশি দিন হলো, সে তার সমবয়সী অন্যান্য বন্ধুদের মত কাজকর্ম বা খেলাধুলা করতে পারছে না। আগে সে সপ্তাহে তিন দিন পাঁচ কিলোমিটার দৌঁড়াতো। আর এখন সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে পারে না, কাজে যেতে পারে না, আগের মত pub এ গিয়ে একটু রোমান্টিক নস্টালজিয়ায় ডুবতে পারে না, গীটারে সুর তুলে গাইতে পারে না। শারীরিক দুর্বলতার এক অদৃশ্য অক্টোপাস যেন তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে।
“আমি এত অসুস্থ হয়ে পরবো জানলে আমি মার্চ মাস থেকেই সবকিছুকেই খুব বেশি সিরিয়াসলি নিতাম। কিন্তু তখন আমরা জেনেছিলাম, কোভিড তরুণদের কিছু করতে পারে না। আক্রান্ত হলেও তা হবে লক্ষণহীন অথবা মৃদু উপসর্গের।শুনেছিলাম, কিছু হলেও দুই সপ্তাহের মধ্যেই সেরে যাবে। অথচ বাস্তবতা এখন উল্টো। এতদিন পরেও রাসেল ভুগতে থাকলো বুক ব্যথা, মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরানো, ব্রেইন ফগ, শ্বাসকস্ট এবং ক্লান্তি ও অবসাদগ্রস্ততায়।”
ইটালিয়ান একটি স্টাডিতে দেখা যায়, হাসপাতালে ভর্তিকৃত ৮৭% রোগী দুই মাস পর্যন্ত বিভিন্ন উপসর্গে ভোগেন। যুক্তরাজ্যের একটি স্টাডিতেও একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। জার্মান একটি গবেষণা, যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী অন্তর্ভুক্ত করা হয় যারা বাসায় চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়- তাদের ৭৮% এর মধ্যে হার্টের বিভিন্ন সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। CDC এর এক সমীক্ষায় দেখা যায় ২৭০ জন নন-হসপিটালাইজড রোগীর মধ্যে তিন ভাগের একভাগ রোগী দুই সপ্তাহ পর তাদের পূর্বের স্বাভাবিক স্বাস্থ্যগত অবস্হায় ফিরে যেতে পারেন নি।
কিংস কলেজ, লন্ডনের এক পরিসংখ্যান মতে প্রায় ছয় লক্ষ লোক Post Covid illness এর কোন না কোন উপসর্গে ভুগছে। প্রায় ১২% ভুক্তভোগী ৩০ দিনের বেশী সময় ধরে Covid Tracker app এর মাধ্যমে তাদের লক্ষণ সমূহের রিপোর্ট পাঠাচ্ছে। ২০০ জনের মধ্যে একজন বলছে, তারা ৯০ দিনেরও বেশি সময় ধরে পোস্ট কোভিডের শারীরিক প্রতিক্রিয়ায় ভুগছে।
যুক্তরাস্ট্রের প্রায় দশ হাজার পোস্ট কোভিড রোগী,যাদেরকে সম্মিলিতভাবে “Long Haulers”বলা হয়,তাদের যন্ত্রণার গল্পগুলো একইরকমভাবে পীড়াদায়ক।
লরেন নিকোলস নামের একজন মহিলা গত ১০ মার্চ কোভিডে আক্রান্ত হন। এরপর তিনি এক মাস পর্যন্ত হাতের কাঁপুনি, তিন মাস জ্বর এবং নাইট সোয়েটে ভোগেন। পাঁচ মাস অতিক্রান্ত হবার পরেও এখনো তিনি উদরাময়ের সমস্যা, সকালে বমিভাব, চরম অবসাদ, অস্বাভাবিক হার্টবিট, ভেরিকোস ভেইন, চামড়ার নিচে রক্ত জমা (excessive bruising), আলো এবং শব্দের অতি সংবেদনশীলতা, শর্ট টার্ম মেমোরি লস এবং শ্বাসকস্ট, যে কারণে অন্তত মাসে দুইবার বাতাসের জন্য গাসপিং করতে করতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে উঠতে হয়।
ফ্রান্সিস সিম্পসন, “Long COVID SOS” নামক একটি পোস্ট কোভিড সাপোর্ট গ্রূপের প্রতিষ্ঠাতা।তিনি বলেন, এই রোগীগুলোর শারীরিক সমস্যাগুলোকে মেডিকেল প্রফেশনের কাছে আমলে নেওয়ার জন্য তাদের মত গ্রুপগুলোর অনেক স্ট্রাগল করতে হয়েছে। তারা খুব কমই সরকারি আনুকূল্য পাচ্ছে। তারা চায় সরকারগুলো করোনা ভাইরাসের এই দীর্ঘ প্রতিক্রিয়াকে আমলে নিক, যারা কাজে ফিরতে পারছেনা তাদেরকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করুক,এবং মাল্টি ডিসিপ্লিনারী ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রোগীগুলোর সমস্যা নির্ণয় করুক, রোগটি নিয়ে গবেষনা করুক এবং চিকিৎসা করুক।
Coverscan clinical trial: এটি একটি ক্লিনিকাল স্টাডি যার মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের উপর কোভিড-১৯ এর দীর্ঘ মেয়াদী প্রতিক্রিয়া online questionnaire এবং আউটডোর ভিসিটের মাধ্যমে ম্যাপিং করা হয়। রাসেল এরকম ৫০০ জন রোগীর একজন যারা এই ট্রায়ালে অংশগ্রহন করছে।
কোভিড-১৯ এর দীর্ঘ মেয়াদী প্রতিক্রিয়া নিয়ে অতি সম্প্রতি আরেকটি গবেষনা শুরু হয়েছে। এই বড় আকারের কোহর্ট স্টাডিতে করোনা ইনফেকশানের প্রথম দিন থেকেই রোগীদেরকে ফলো আপ করা হচ্ছে এবং দেখা হচ্ছে ইনফেকশনের কততম দিন থেকে তাদের শরীরে post viral fatigue ডেভেলপ করছে।
৯০% এরও অধিক “long haulers” শারীরিক পরিশ্রম পরবর্তী গা-ব্যাথা বা post exertional malaise এ ভোগেন। একটু সিঁড়ি বেয়ে উঠলেই শরীরটা ভেঙে পড়ে, ক্লান্তিবোধ হয় এবং মাংসপেশীর ব্যাথা ও দুর্বলতা অনুভব করেন। এটাকে myalgic encephalomyelitis, বা chronic fatigue syndrome এর লক্ষণ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
গত দুই তিন বছর পূর্বে সম্পাদিত অনেকগুলো স্টাডিতে দেখানো হয়েছে যে Myalgic Encephalomyelitis রোগটি ভাইরাস পরবর্তী ইম্যিউনোলজিকাল রিএকশানের কারণে হতে পারে। গবেষকরা ধারণা করছেন cytokine storm / ? bradykinin storm এর ইমিউনোলজিকাল রিএকশান হয়তো ব্রেইনের হাইপোথ্যালামাস এবং স্পাইনাল কর্ডকে এফেক্ট করতে পারে। যদি Post Covid Fatigue এবং Myalgic Encephalomyelitis ভাইরাস জ্বনিত ইমিউনোলজিকাল রিএকশানের সাথে সম্পর্কিত হয়, তাহলে উক্ত গবেষনায় উভয় দুটি ক্লিনিকাল কন্ডিশানের সমাধান পাওয়া যেতে পারে।
Long Covid এর দু:সহ বোঝা টানতে টানতে
চার্লি রাসেল নিস্প্রভ বিষন্ন চেহারা নিয়ে একদিন বললো, “এখন লোকজন যখন মাস্ক পরতে চায়না, সামাজিক দূরত্ব বিধি মানতে চায়না, তাদের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হয়, “তোমরা দ্যাখো, আজ ছয়টি মাস আমার লম্বা লেজ ওয়ালা কোভিড নামের এক রহস্যময় নোভেল সর্পের সাথে বসবাস। তার পরেও কি তোমরা স্বাস্হ্যবিধি মানবে না? তার পরেও কি তোমরা সচেতন হবে না?”