২৩ মার্চ ২০২০:
ডা. জাহিদুর রহমান
ভাইরোলজিস্ট, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
লকডাউন এমন একটি পরিস্থিতি যাতে কোন জরুরি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ একটি নির্ধারিত সময়ের জন্য নির্দিষ্ট কোন স্থাপনা বা অঞ্চল থেকে বের হতে অথবা প্রবেশ করতে পারে না। লকডাউনের বৈশিষ্টগুলো নির্ধারণ করা হয় এর কারণের উপর। যেমন পুলিশ খবর পেল একটি স্কুলে বোমা পাওয়া গিয়েছে। তখন তারা শুধু মাত্র ঐ স্কুল বিল্ডিং কিংবা ক্যাম্পাসকে লকডাউন করতে পারে। কোভিড-১৯ প্যানডেমিকের সময় লকডাউন করা হয় মূলত এর সংক্রমণ প্রতিহত করতে অথবা বন্ধ করতে। কয়টি স্থাপনা কিংবা এলাকা লকডাউন করা লাগবে সেটা নির্ধারণ করবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। অনেক সময় একটা প্রদেশ কিংবা আস্ত দেশও লকডাউন করার প্রয়োজন হয়। লকডাউনের ঘোষণা দেয়াটা খুব সহজ, কঠিন হল এটি কার্যকরভাবে পালন করা। মিরপুরে কোভিড-১৯ এর কয়েকজন রোগি পাওয়ার কারণে পুরো ঢাকা শহর লকডাউন করার সিদ্ধান্ত নেয়াটা একজন ফেসবুকার হিসেবে সহজ হলেও বিশেষজ্ঞদের কাছে সহজ বিষয় না। কোয়ারাইন্টাইন, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং, টেস্টিং, আইসোলেশন, এই কাজগুলো একই সাথে, সমান্তরালে না এগিয়ে নিলে লকডাউন লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি করবে। আপনি যদি আক্রান্তদের চিহ্নিত না করেন, তাহলে আপনার কোন অধিকার নেই আমাকে আটকে রাখার। বিশাল সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষের কথাও আপনাকে মাথায় রাখতে হবে। এক মাস লকডাউন থাকলে পরের সময়টিতে যে ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয় হবে, সেটাও মাথায় রাখতে হবে। ২ কোটি মানুষের একটা শহর লকডাউন করে সেটা চলমান রাখার মত লোকবল আছে কিনা সেটাও ভেবে দেখতে হবে।
কোভিড-১৯ ভাইরাসের প্যানডেমিকে কোন নির্দিষ্ট স্থাপনা বা এলাকা লকডাউন চলাকালীন সময়ে যেহেতু মূল উদ্দেশ্য জনসমাগম না হতে দেয়া, সেহেতু বিভিন্ন দেশে নিচের ব্যবস্থাগুলো নেয়া হয়েছে। আমাদের দেশের লকডাউন ঘোষণা হলেও এর খুব বেশি ব্যতিক্রম হবে না।
★লকডাউন করা এলাকা থেকে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কেউ ঢুকতে বা বের হতে পারবে না।
★হাসপাতাল, পুলিশ স্টেশন, গণমাধ্যম, ইত্যাদি কয়েক ধরনের অফিস ছাড়া বাকি সব ধরণের অফিস বন্ধ থাকবে।
★খাবার, ঔষধ, সুপারসপ, ইত্যাদি কয়েক প্রকার দোকান ছাড়া বাকি সব দোকান বন্ধ থাকবে।
★জনসমাগম হতে পারে এমন সব স্থাপনা যেমন শপিং মল, সিনেমা হল, মসজিদ, মন্দির, স্টেডিয়াম, বিনোদন কেন্দ্র, পার্ক, ইত্যাদি বন্ধ থাকবে।
★জরুরি কাজে নিয়োজিত যেমন এম্বুলেন্স, খাবার বহনকারী, মিডিয়ায় কাজে ব্যবহৃত যানবাহন ছাড়া সব ধরণের যানবহন চলাচল বন্ধ থাকবে (বিশেষ করে গণপরিবহন)।
★ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বাসার বাইরে বের হওয়া যাবে, তবে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং মেনে চলতে হবে।
আমাদের সবার মনে রাখতে হবে সেনাবাহিনী মোতায়েন হলেও লকডাউন বিষয়টি জরুরি অবস্থা বা ১৪৪ ধারা থেকে আলাদা। এখানে মানুষ মানুষের শত্রু না, শত্রু হল ভাইরাস। একটি নতুন ভাইরাস, যার সংক্রমণে লক্ষণ প্রকাশ না করেও আমরা অন্যকে সংক্রমিত করতে পারি। শেষ কথা হিসেবে বলতে চাই, কমিউনিটিতে SARS-CoV-2 এর সংক্রমণ ঠেকাতে অবশ্যই লকডাউন করা লাগবে। কিন্তু সেটি সুপরিকল্পিত হতে হবে। দুঃখজনক বিষয় হলেও সত্য সেই পরিকল্পনা করার মত যোগ্য লোক নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে নাই। নাই, নাই, নাই। সুতরাং সেই মানুষগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে খুঁজে বের করতে হবে। সেলিব্রেটি না, মেধাবী লোকজন লাগবে। নেতা না গবেষক লাগবে। দেশে না পাওয়া গেলে বিদেশ থেকে আনতে হবে। বৈশ্বিক মহামারিতে পুরো পৃথিবী একটি পরিবার। যে দেশ গোয়ার্তুমি করে অন্য দেশের সাহায্য চাইবে না, সেই দেশই ঠকবে। তারপরও যদি আমাদের হুশ না হয়, বিশ্ববাসী তাদের নিরাপত্তার স্বার্থেই এক পর্যায়ে আমাদের দেশটিকে বর্জন করবে।