প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২০, শনিবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
মেডিকেল অফিসার, উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স
কবি ইমতিয়াজ মাহমুদ আমার একজন প্রিয় মানুষ। এ তথ্য আমার আশেপাশের অনেকেই জানে। উনি একবার আমার এক স্ট্যাটাস শেয়ার করেছিলেন। উনার ভাল লাগলেই উনি নানা জনের লেখা শেয়ার করেন। এখানে ওনার সেলিব্রিটি, নন-সেলিব্রেটি বাছবিচার নেই। কিন্তু আমার জন্য সেটি ছিল এক বিশেষ দিন। আমি বারো বছরের জীবনে ওই একটি স্ট্যাটাসই সেভ করে রেখেছি। স্ট্যাটাসটি ছিল এরকম-
শেখ সাদীর বয়স তখন ছয় বছর। এক বিশেষ রাতে তার বাবার সাথে তিনি মসজিদে গেলেন আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করতে। সেখানে অনেক লোক।
শেষ প্রহর। প্রায় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। যারা আছেন তারাও ঘুমে ঢুলুঢুলু। ছোট সাদী তার বাবার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘বাবা, তুমি আর আমি ছাড়া সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমরা দুজনই শুধু জেগে আছি।’
তার বাবা, যিনি ছিলেন দরবেশ; বললেন-
‘তাহলে আমরাও ঘুমিয়ে পড়ি। নিজেকে মহৎ ভাবার চেয়ে ঘুমই ভালো।’
এ করোনার সময়ে কখনো কখনো কেউ এতো রেসপেক্ট দেখান, মনে হয় মাঝেমাঝে ঘুমানোই উত্তম! অনেকদিন ধরে ডায়েরিটা লিখছি। ফেসবুকে তো ডায়েরি হয় না, ডায়েরির মতো করে লিখছি। ফেব্রুয়ারি থেকেই লিখছিলাম। যেদিন এ জেলায় লকডাউন ঘোষিত হয়, সেদিন থেকে দিন গোনা শুরু করলাম। এখন সম্ভবত শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি। এখন আর কেউ করোনা নিয়ে উদ্বিগ্ন নয়। পুরো নিউজফিডে করোনা নিয়ে কোনো স্ট্যাটাস থাকে না।
অনেক কথা বলেছি। অনেক ব্যক্তিগত কথা। ফেসবুকের শুরু থেকে যে নীতি মেনে এসেছি- ‘ব্যক্তি কথা কিছু শেয়ার না করা’। কখনো আমার দ্বিতীয় ছবি দেই নি। প্রোফাইল পিকচার এ আইডির শুরু থেকে এটি। নিরানব্বই শতাংশ আত্মীয় স্বজনকে ব্লক করে রেখেছি এবং আমার বা আমার পরিবারের কোনো ইভেন্ট ফেসবুকে কখনো আসে নি। সে পরীক্ষা পাশ হোক বা ভাই বোনের বিয়ে কিংবা কোনো বিশেষ কিছু। আমি কখনো ফেসবুকে জন্মদিন উদযাপন করি না। বছরের ওই সময়ে এ আইডি ডিএক্টিভেট থাকে। কোথায় আছি যাচ্ছি কিছুই সাধারণত বলি না। সে আমি এ তথাকথিত ডায়েরির নামে আমার কথা অনেক শেয়ার করেছি।
এ কয়দিনে অসংখ্য জনের কথা লিখেছি। বেশিরভাগ আমার কলিগ, বন্ধু বান্ধব, প্রতিবেশী, অল্প পরিচিত, এমনকি অপরিচিত। ম্যাসেঞ্জারের কথাও তুলে এনেছি। মিথ্যে কথা লিখি নি তবে কখনো কারো নাম পরিচয় উল্লেখ ছিল না। কয়েকজন নিশ্চিত করে বুঝতে পেরেছেন তার কথা বলছি। বিরক্তও হয়েছেন। তাদের কাছে আমি ঋণী।
আমি শুধু সময়টাকে ধরে রাখতে চেয়েছিলাম। যা দেখছিলাম লিখে গেছি। চরিত্রগুলো এঁকে রাখতে চেয়েছি, যেকোনো নামই যেন সেখানে বসে যায়।
৬/০৮/২০২০
বাসগুলো এখন বর্ধিত হারে ভাড়া নিচ্ছে। সব সিট পূর্ণ করে দাঁড়িয়েও লোক নিচ্ছে। এ দেশে কোনো বিপদ একা আসে না। করোনার সাথে নতুন যোগ হয়েছে ঠকানো। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ আছে, পুলিশ বক্স আছে, এক দুই প্রশাসনের লোকও নিশ্চয় বাসে চড়েন- কেউ কিছু দেখেন না।
কলিগ স্থানীয় এক ছোটভাইকে বললাম-
‘কোথায় কমপ্লেন দিবো এ নিয়ে? ডিসি অফিস, থানা, হাইওয়ে পুলিশ, সিভিল সার্জন, কোথায় দিব?’
তার জ্ঞান বুদ্ধি অনেক বেশি। সে আমাকে এ প্রসঙ্গে এক গল্প বললো।
এক আমেরিকান কৌতুকাভিনেতা ছিলেন। যিনি মানুষকে হাসাতে হাসাতে পেটব্যথা করে ফেলতে পারতেন। একজন লোক যত দুঃখ যত হতাশা নিয়েই তার কাছে আসুক, তার কথায় একবার হলেও ফিক করে হাসতো। তো একবার দুষ্টু কিছু ছেলে তার কাছে চ্যালেঞ্জ নিয়ে গেল। দশ হাজার ডলার বাজি। তিনি শত চেষ্টা করেও নাকি এক মহিলাকে হাসাতে পারবেন না।
ভদ্রলোক চ্যালেঞ্জটি নিলেন এবং তার ভান্ডারের সেরা সেরা সব হাসির গল্প বলেও সে মহিলার কোনো ভাবান্তর ঘটাতে পারলেন না। বাজি হেরে টাকা তো দিলেন কিন্তু কৌতূহল মেটাতে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ঘটনাটা কি!’
তারা তখন তাকে বলল,
‘এ মহিলা কানে শোনে না, চোখে দেখে না, কথাও বলতে পারে না। হাসবে কিভাবে?’
আমাদের কর্তৃপক্ষ হচ্ছে এরূপ। কমপ্লেন টমপ্লেন দিয়ে তেমন লাভ হবে না। যা করা যেতে পারে আখের গোছানো। এ লুটেরাদের দেশে কেউ তোমাকে লুট করছে, তুমি তোমার উপায়ে তাকে লুট করো। যে বেশি লুটতে জানবে- সেইই জয়ী!
সম্ভবত এ মহামারী সবচেয়ে বড় এ শিক্ষাটি নিয়েই এসেছিলো। এখানে কিছুই বদলাবে না। নিজের বাঁচন নিজেকেই বাঁচতে হবে।