প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৪ জুলাই ২০২০, শনিবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
শুক্রবার করে একটু দূরে যাই। কিছু রোগী দেখি। ক্লিনিক মালিক সম্মান টম্মান করে। চেম্বারে সিরিয়ালের জন্য এসিস্ট্যান্ট লাগে। ক্লিনিক এক মেয়েকে দিলো। শুনলাম তার হাজব্যান্ড বদমাইশ, তাকে ছেড়ে চলে গেছে। এখন সে একা এক বাচ্চা নিয়ে থাকে। ক্লিনিক থেকেই এসিস্ট্যান্টদের মাসোহারা বেতন। কিন্তু ভিজিটর ডাক্তাররা সবাই বখশিশ দেন।
আমিও দেই। এক শুক্রবার সে ভুলে এক রোগীর রিপোর্ট আরেক রোগীকে দিয়ে দিলো। এতো মেজাজ খারাপ হলো- দিলাম ডেকে ঝাড়ি। বেচারি ভয়ে যাওয়ার সময় আর সামনেই আসলো না। আমারও রাগ তখন পড়ে নি। সেদিন আর বখশিশ দিলাম না।
আসার পথেই মনে খচখচ শুরু হলো। সামান্য টাকা- মেয়েটা হয়তো আশা করে বসে থাকে। এটি বেতনের বাইরের হিসেব। কিছু শখ মেটায় অথবা প্রয়োজনেই খরচ করে। এক ভুলের জন্য বকা দিছি, আবার ও টাকায় হাত দিলাম! না, কাজটা জঘন্য হলো। আবার আমি নিজেকে বোঝাই- আমি সবচেয়ে বেশি দেই/ এ দিতে আমি বাধ্য নই/ সে ক্লিনিক থেকে পায়/ আর সে নিজে কেন ছিল না/ খুঁজে খুঁজে দেওয়া আমার কর্ম নয়- ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু মন মানছিলো না। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সামনের সপ্তাহে এটি পুষিয়ে দেব।
কিন্তু কী কপাল! দেশে কোভিড চলে আসলো। আমি যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। আমি কেন প্রায় সব ডাক্তাররাই চেম্বার প্র্যাক্টিস বন্ধ করে দিলেন। ক্লিনিক মালিকরাও বললো- ‘আগে জান তারপর জাহান’। কিন্তু কোভিডের এ দেশ পছন্দ হয়ে গেল, যাওয়ার নাম নেই। কি করি- এভাবে আর কতদিন! কয়েকজন ডাক্তায় ছিটায় ছিটায় যাওয়া শুরু করলো। জুন মাস থেকে আমিও যাওয়া শুরু করলাম।
গিয়ে দেখি সে মেয়ে নেই। ক্লিনিক কর্তৃপক্ষকে বললাম- ‘আমার পুরনো এসিস্ট্যান্ট কই?’ বললো- ‘স্যার বাধ্য হয়ে আমরা কিছু কর্মী ছাঁটাই করেছি’। এতো খারাপ লাগলো! ভাবলাম কেন যে সেদিন এমন করতে গেলাম। মেয়েটাকে বকলাম আবার টাকাও দিলাম না। লাস্ট ডিউটিটা সে আফসোস নিয়ে গেল। নিশ্চয় ওই দিনটাতে বাকি সবাই পেয়েছে সে পায় নি, তার খুব খারাপ লেগেছে। আমরা যাওয়ার পর তারা এসব আলোচনা করে কিনা কে জানে! করলে হয়তো লজ্জায় মাটির সাথে মিশেই যাচ্ছিলো। আমার দোষেই এমন হলো। এখন তার চাকরিও নেই। কিভাবে চলছে একা মানুষ বাচ্চাটাকে নিয়ে- কে জানে! বয়সও বেশি না। বিশ বাইশ হবে।
আজ ক্লিনিক পৌঁছতেই সে দৌড়ে এসে সালাম দিলো। এতো খুশি হইছি, আমার মনে হয় না আমার জীবনে অনাত্মীয়- অবন্ধুয়ীয়- অগুণমুগ্ধ কাউকে দেখে কখনো এতো খুশি হয়েছি। মন থেকে যেন এক পাপের বোঝা নামলো! দিলাম ঝাড়ি সে এতোদিন কেন আসে নি এর জন্য। পোলাপানকে সবসময় ঝাড়ির উপর রাখতে হয়, যেন ঝাড়ি শুনে ভবিষ্যতে অভিমান করে না পালায়…!
এ গেল যুক্তির বাইরের খবর। এর ভিতরেও এক পৃথিবী আছে- যুক্তির পৃথিবী। সেখানেও অশান্তি। আবার নাকি নিয়োগ হবে ২০০০ জন ডাক্তারের। কেউ কেউ বলছে সেটি নাকি ৩৯ তম থেকে হবে। প্রথমে সাড়ে চার হাজার, তারপর দুই হাজার, তারপর আবার দুই হাজার। আমার দৃষ্টিতে একটু বেশি বেশিই হয়ে যাচ্ছে। গতকাল একটু হতাশা দেখেছি জুনিয়রদের মাঝে।
আমরা কেউ নিশ্চিত নই আমরা বাঁচবো কিনা, কিন্তু আমরা এটি নিশ্চিত- পৃথিবী একদিন আবার আগের ধারায় ফিরে যাবে। মানুষ আড্ডা দিবে, হ্যান্ডশেক করবে, কোলাকুলি করবে। বিসিএস চাকরির স্বপ্নটা সেখানে। সে স্বপ্ন সবাই দেখছে। যখন করোনা থাকবে না- মসৃন এক জীবন হবে। ‘সুযোগ’ যখন অন্যকে বঞ্চিত করে হয়- সেখানে ভাল কিছু হয় না। আমি মনে করি- দ্রুততম সময়েই নতুন ডাক্তার নিয়োগ হোক, কিন্তু সে ফ্রেশ প্রতিযোগিতায়। ৩৯ এর প্রজ্ঞাপনের পর বহু ডাক্তার বের হয়েছেন। বহু ডাক্তার ৩৯ এই একটুর জন্য প্রিলি পাশ করতে পারেন নি। তারা তো কোনো দোষ করেন নি। স্বপ্ন দেখা, ফের স্বপ্ন দেখা- তো দোষের কিছু না।
কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত নেবে।
এদিকে আমার বড়ভাইয়ের ছেলেটি অসূর্যম্পশ্যা হয়েই বড় হচ্ছে। কোভিড উনিশের সবচেয়ে ইনোসেন্ট ভিক্টিম তারা। এখন সে কারো কোলে চড়ে বাইরে বের হতে পারে না। আমার ধারনা কখনো কখনো জানালা দিয়ে অবাক চোখে ‘বড় মানুষ’দের দেখে। কখনো অপরিচিত কাউকে দেখলে চমকে উঠে!
কয়েকদিন আগে চৌদ্দমাস বয়সে সে তার জীবনের প্রথম সাইকেলটি পেলো। তার বাবা কিনে দিয়েছে। সে প্রথম বুঝেছে হামাগুড়ি না দিয়ে, না হেঁটে, না কোলে চড়েও এগুনো যায়। সেখানে পরিশ্রম কম, সাফল্য বেশি। এগুলোকে বলে ‘মেশিন’। এর সাথেই দোস্তি মনুষ্য প্রজাতির। দেবতাদের বাহন জীবিত প্রাণী, মানুষের বাহন জড় মেশিন।
সে সারা ঘর দৌড়ে দৌড়ে সাইকেল চালায়। এক ভিডিও, পাঁচ সাত ছবি বারবার দেখি। ভাবি- আবার কবে যে বাসায় যাব..!
বড় হয়ে যাচ্ছে ছেলেটা।