প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৯ জুন ২০২০, সোমবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
এক কলিগ কাজ করে ডেডিকেটেড হাসপাতালে, বলছে তারা সবাই পজিটিভ হওয়ার ভয়ে আছে। প্রায় সবার সিম্পটম হচ্ছে। কারণ নিম্নমানের মাস্ক। তার এখন আফসোস হচ্ছে কেন সাপ্লাইয়েরটা ব্যবহার করতে গেলো। বাস্তবতা হচ্ছে এতো দাম দিয়ে মাস্ক কেনার ক্ষমতা আমাদের অনেকেরই নেই। সরকারী বেতন একাউন্টে ঢুকার আগেই পাওনাদারদের নামে বরাদ্দ শেষ হয়ে যায়।
ন্যুনতম কোয়ালিটির মাস্ক ৩০০ টাকার উপরে পড়ে। যেগুলোর দাম কম সেগুলোর কোয়ালিটি নেই। এক মাস্ক ধুয়ে ধুয়ে বড়জোর পাঁচ সাতদিন পরা যায়। আমরা অগুনিত বার পরি। কাজ হচ্ছে না জেনেও পরি। কখনো কখনো সস্তা মাস্কই পরি। নাকের পাশের অংশটা খোলা থাকে। ওই যে বলে না- হ্যাপিনেস হচ্ছে নিজের ভেতর..! নিজেকে নিয়ে হ্যাপিই ছিলাম, মাঝে কর্তৃপক্ষ ওই রসিকতাটা না করলেও পারতো।
ঢাকা মেডিকেলে ডাক্তারদের থাকা খাওয়া বাবদ একমাসে খরচ বিশ কোটি টাকা! কয়েকজন খাবারের নমুনা শেয়ার করলেন। অবিশ্বাস্য যোগ বিয়োগ। মানে কিছুলোক এ সময়েও দুর্নীতি করছে। অথচ আমরা ধার্মিক, দেশপ্রেমিক, সৎ। জাতীয় দিবস গুলোতে কী আবেগ! ধর্ম নিয়ে আমাদের কত প্রেম! ভাগ্য ভালো, ওরা দুর্নীতিতে ফার্স্ট সেকেন্ড দেয়। ভণ্ডামিতে দেয় না। দিলে এক থেকে একশো পর্যন্ত আমরাই হতাম।
গতকাল একজন চট্টগ্রামে মারা গেলেন নিজের চেয়ারে বসে। যেন ঘুমাচ্ছেন। ভয়ে কেউ কাছে যায় নি। এরকম ঘটনা ঘটছেই। আমি হাসপাতালে ওপিডিতে বসে দেখি মানুষ স্বাস্থ্যবিধির কিছুই মানে না। এসব নিয়ে দুশ্চিন্তাও করে না। কিন্তু যখনি শুনে কাউকে করোনা রোগী বলে সাসপেক্ট করা হচ্ছে- তাকে এড়ানোর বিশ্বরেকর্ড করে ফেলে। অন্যকে ঘৃণা করার, অন্যকে এড়ানোর, অন্যকে ছোট প্রমাণ করার ন্যুনতম সুযোগ এদেশের মানুষ ছাড়ে না।
টেস্ট সম্ভবত আরো কমে যাচ্ছে। এখন সপ্তাহে দুইদিন দুইটি করে মাত্র চারটি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে- করোনা টেস্ট এখন লটারিতে ছাড়তে হবে! এখন রোগীদের মাইন্ড সেটাপেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। তারা জিজ্ঞেস করে ‘রিপোর্ট কবে আসবে?’ আমরা বলি ‘জানি না’; কেউ কিছু মনে করে না। আমরা রোগীদের ডিউটি ডক্টর রুমে ঢুকতে দেই না। (যদিও আমাদের রুমে দোতালার প্রস্বাব চুয়ে চুয়ে পড়ে, ওয়াশরুমের বেসিনে পানি আসে না, জানালার ভাঙ্গা কাঁচ দিয়ে অবিরাম মশা ঢোকে।) তারা এ গা বাঁচানো স্বভাবে কিছু মনে করে না। স্টেথোস্কোপ বুকে পিঠে না ছোঁয়ালেও কিছু মনে করে না। আগে অপেক্ষা করতো।
এই টেস্ট, রিপোর্ট আর এভোয়েডেন্সের চক্করে পড়ে রোগীরা অধিকাংশ বুঝে গেছে বাঁচতে হলে নিজেকেই বাঁচতে হবে। মানুষ আইভারমেক্টিন, এন্টিবায়োটিক, ভিটামিন সি, জিঙ্ক- লিস্ট ধরে ঔষধ গিলেছে। কোথাও কোথাও মারাত্মক ফল হচ্ছে। চল্লিশ হাজারের ভিটামিন ডি যেটি সপ্তাহে একটি খাওয়ার কথা- প্রতিদিন একটি করে সাতদিন খেয়ে ফেলেছে! স্টেরয়েড দিনে তিনবেলা করে খেয়েছে সামান্য ঢোক গিলতে গলা ব্যথার জন্যই! একই পদের দুই তিন রকম এন্টিবায়োটিক গিলছে। ফার্মেসি ফেসবুক মোবাইল- যে যেমন যেখান থেকে পারে ট্রিটমেন্ট নিচ্ছে।
কোভিড উনিশ আসার আগে কখনো ভাবি নি আমরা বাঙালিরা কত ছোট জায়গা নিয়ে থাকি। এখানে আইসোলেটেড থাকার মতো বাড়তি ঘর নেই প্রায় কোনো বাসায়। ওয়াশরুমের দিকেও আমরা অনেক গরিব। গতকাল একজন জ্বরের রোগী বলছিলেন- ডায়েবেটিসের জন্য উনি অন্ধ, অসম্ভব তার পক্ষে আলাদা থাকা। বলি ‘ঘরেও সবাই মাস্ক পরে থাকেন’। সম্ভবত এটুকুই সর্বোচ্চ যা আমরা করতে পারি। যুদ্ধের নিয়মই তাই- হারাতে যখন হবেই, যতটা সম্ভব কম হারানো যায়।
তবে এর মাঝেই এমন অনেক সংবাদ আসে যেগুলোর কোনো পাঠক নেই। জিতে যাওয়া গল্পের চেয়ে হেরে যাওয়ার গল্পই আমাদের বেশি শান্তি দেয়। আমার এক জুনিয়র তার মা-কে নিয়ে বাড়ি ফিরতে পেরেছে। প্রায় ষোলো সতেরো দিন স্কয়ার হসপিটালে ভর্তি রেখেছিল। টসিলিজুমেব ইঞ্জেকশন চলেছে বেশ কয়েকটি। প্রতিটির দাম সত্তর হাজার টাকা করে। ডিসকাউন্ট সহই যে ফিগারটি আসে অবিশ্বাস্য। অন্তত আমাদের লেভেলে বটেই। সে মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে নিজেকে বন্ধক রেখে। সামনের এক বছর স্যালারি থেকে তার পঞ্চাশ শতাংশ বেতন কেটে নিবে।
মায়ের বিপরীতে ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা- কিছুই না। কত লোক কত বড়লোক। ঢাকার নাইট ক্লাবগুলোয় জুয়ার বোর্ডেই নাকি কোটি কোটি টাকা উড়তো। অবৈধ হিসেব বাদ দিয়ে বৈধ হিসেব ধরলেও আমি পাঁচ হাজার টাকার ইফতারি প্লেট দেখেছি। বসুন্ধরা সিটিতে দুই হাজার টাকায় এক শার্ট কেনার জন্য আমি নিজেই লাইনে দাঁড়িয়েছি। চারজনের পরিবারে লক্ষ টাকার পশু কোরবানি করতে দেখেছি শুধু স্ট্যাটাস মেন্টেন করার জন্য। আর এ ছেলেটা- একজন ডাক্তার, একজন ট্রেইনি- ডিসকাউন্ট সহ তার মাকে চিকিৎসা করার জন্য নিজেকে এক বছরের জন্য বন্ধক রেখেছে। আমার অঢেল টাকা থাকলে আমি ওকে পে করতাম- মাতৃপ্রেমের যে শিক্ষা সে আমাকে দিয়েছে সে জন্য!
অনেক অফিস অনলাইনে দৌড়াচ্ছে। কিন্তু স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যা হচ্ছে তা স্রেফ লোক দেখানো ছাড়া কিছুই না। অবশ্য আমাদের অফলাইন স্কুল কলেজও লোকদেখানো ছিল। যারা ভাল রেজাল্ট করতো নিজেরা পড়তো। কোনো কিছুর জন্যই এদেশে কোনো কর্তৃপক্ষ দায়ি নয়। সে পড়াশোনা হোক, সঠিক বিদ্যাচর্চা হোক, চিকিৎসা হোক, বা বেঁচে থাকা হোক।
এখন একটি জিনিস বুঝি। টাকা জিনিসটা খুব দরকারি। আনন্দ, আদর্শ, স্বপ্ন, মানবতা, নীতি- এসবের চেয়ে অনেক বেশি দরকার টাকা। পৃথিবীতে ওসব ছাড়াও বাঁচা চলে, টাকা ছাড়া বাঁচা যায় না। কারন এমন ক্রাইসিস আসতে পারে যখন সবাই ছেড়ে চলে যাবে, শুধু টাকা পক্ষে হয়ে কথা বলবে। অন্তত চেষ্টা করবে।
আমরা সব ভুল পড়েছি। ভুল জেনেছি।