প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৩ জুলাই ২০২০, শুক্রবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
‘ওই দাঁড়া’ বলে দৌড়ে আসলো ছেলেটি। চিকন সুতোয় ঝুলানো লাইটারটি স্প্রে দিয়ে জীবানুমুক্ত করলো। তারপর সিগ্রেট ধরালো। অনেকে এখন পার্মানেন্টলি লাইটার সাথে রাখছেন। কমন লাইটারে ভাইরাস থাকতে পারে এ ভয়ে। তারপর সিগ্রেট শেয়ার করে খাচ্ছেন। ঠোঁটে দেয়ার আগে ফিল্টার আলতো করে মুছে নিচ্ছেন। ভাইরাস যদি কথা বলতে পারতো, বলতো ‘ভাই, ক্যান্সার কী আমার চেয়ে বেশি ভাল?’
এরকম অদ্ভুতুরে সচেতনতা আমরা বহুদিন ধরে দেখাচ্ছি। মাস্ক নাকের নিচে রেখে রিকশার সিট স্প্রে করে রিকশায় বসতে দেখেছি। হাসপাতালে এক মাস্ক দিয়ে নেবুলাইজেশন হচ্ছে বছরের পর বছর, অথচ সব দুশিন্তা ওয়ার্ড আইসোলেশন নিয়ে। পালস অক্সিমিটার নিয়ে। লোকে প্রেশারের ঔষধ বাদ দিয়ে ডি-রাইজ সিভিট রেক্স হাবিজাবি খাচ্ছে!
আজ ডিউটি দিয়ে এগারো দিনের সংগ্রাম শেষ হলো। কাল থেকে আবার কোয়ারেন্টাইন ডে শুরু। এ ডিউটি গুলো এখন প্রফের পরীক্ষার মতো লাগে। দাঁতে দাঁত চেপে পাড় করা। পিপিই মাস্ক গ্লাভস গ্লাস পরে বসে থাকা খুব কষ্টের। মাথার উপরের ফ্যানটা বেশি জোরে ঘুরে না। এক বন্ধু বললো ‘সারভাইভাল মুভি দেখে ডিউটি করবি’। এবার তাই করলাম। ডিউটিতে আসার দুইদিন আগে থেকে ‘স্পার্টাকাস’ দেখা শুরু করেছি। ভয়ংকর ছবি। আগে ভাবতাম গ্রামের মানুষরা খুব মারামারি করে, এবার মনে হলো- ‘এগুলা তো কিছুই না’!
শেষদিকে এক ইলেক্ট্রোকুশনের রোগী আসলো। কম বয়সী ছেলে। ভয় পেয়ে গেছে। ভর্তি দিলাম। সাধারণত এ রোগী গুলোকে অনাত্মীয়রা নিয়ে আসে। একজন বললো ‘মামা ভর্তি না করলে হয় না..’। আরেকজন বললো ‘দাদা বাড়ি তো দূর, থাকনের মানুষ নাই’। আমি বললাম ‘আগে ঠিক করেন আমি আপনাদের মামা, চাচা না দাদা, তারপর বলছি..।’ তারা ফের আলোচনায় বসলো।
প্রথম আলোয় দেখলাম সাবেক অর্থমন্ত্রী স্কয়ার হসপিটালের প্রয়াত মীর্জা স্যারকে নিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি লিখেছেন। দেখার পর থেকেই ভাবছি কাল যারা মেডিকেল ক্যাডার ছেড়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে পররাষ্ট্র- প্রশাসন- পুলিশ ক্যাডারে চলে গেলেন, তাদের একটুও আজ বাধবে কিনা! নাই বা লোকে ডাকলো ‘স্যার’, নাইবা পেলো ভয়, নাইবা ওয়াশরুমের বেসিন বেয়ে পানি গড়ালো, একদম অচেনা অজানা মানুষ দূরতম কোনা থেকে এসে একবার তো বলবে ‘আহা মারা গেলো লোকটা! গত ফেব্রুয়ারিতেই তো দেখালাম..!’
সবচেয়ে কাছের বন্ধুটার বিয়ের চিঠি কতদিন থাকে বলুন, অথচ নাম শুনে নিয়ে লেখা অচেনা মানুষের সাক্ষর দেয়া চিঠি মানুষ রেখে দেয় সারাজীবন। একটুই তো সময় শেয়ার করেছিল। তার প্রমাণস্বরূপ এক চিঠি। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘প্রেসক্রিপশন’।
মীর্জা স্যার জাঁদরেল সচিব ছিলেন না, বড় পুলিশ কর্তাও ছিলেন না, ছিলেন না ডাকসাইটে কোনো কূটনৈতিক; কিন্তু এ গ্রহে এক দুইজন তো আছেন যারা তার হাতের লেখা নিয়ে বেঁচে আছেন। তার সাথে আরেকবার দেখা করার ইচ্ছে নিয়ে ওয়েটিংরুমে বসতে রাজি আছেন। তারা তার অনাত্মীয়, অপরিচিত। সাবেক অর্থমন্ত্রী হয়তো এমনি একজন। আর কোথায় আছে এমন একতরফা প্রেম?
প্রায় সবাই চলে গেছে। ডর্মিটরিতে বসে একা নীরবতা শুনছি। নীরবতা মানে শব্দের অনুপস্থিতি নয়, ভিন্নরকম উপস্থিতি। সব অপরিচিত মুখের মাঝে এক পরিচিত মুখ, খুঁজে নিতে কষ্ট হয়। অথচ সবাই তাকে চেনে। পাহাড়ের নীরবতা, রংপুরের নীরবতা আর ডর্মিটরির নীরবতা- এক নয়। জীবন বদলাচ্ছে, সাথে সব সঙ্গা বদলাচ্ছে। নীরবতাকে আমরা পার্সোনাল এক স্তর থেকে আরেক স্তরে তুলছি।
কোভিডকে ধন্যবাদ এমন উপলক্ষ এনে দেয়ার জন্য।