১০ এপ্রিল ২০২০:
ডা. শুভদীপ চন্দ
এ কয়দিন সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নটির সম্মুখীন হয়েছি- ‘কেন স্কয়ার হসপিটালের চাকরি ছেড়ে এ কম বেতনের সরকারি চাকরিতে ঢুকলাম?’ করোনা মানুষের জীবনকে এমন এক জায়গায় নিয়ে এসেছে যে মানুষ জীবনের মিসিং পয়েন্টগুলো খুঁজছে।
আজ এক ইতালি ফেরত লোকের সাথে দেখা হলো। উনি হাসপাতালে এসেছেন কোয়ারেন্টাইনের মেয়াদ শেষের সার্টিফিকেট নিতে। কোনকিছুই চিরস্থায়ী নয়। চৌদ্দদিনের কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশনও। আমরা যদি সেসময় বিমানবন্দরের কয়েক একর জমি লক করতে পারতাম, আজ সারাদেশকে এভাবে লক ডাউন হতে হয় না। ‘মিসিং পয়েন্ট’। উনি বলছিলেন প্রবাস জীবনের বিভীষিকার কথা। উনি বলছিলেন ‘কেন গিয়েছিলেন’ সে ভুলে ভরা দিনগুলোর কথা। আরেকটি ‘মিসিং পয়েন্ট’।
আমরা এখন একটি লকডাউন শহরের বাসিন্দা। আজ দ্বিতীয় দিন। আমার হাসপাতাল বিশ কিলোমিটার দূরে। রাতে যখন ঘুমাতে যাই, আমি জানি না সকালে কিভাবে যাব! সকাল সাড়ে সাতটায় বাজারে গেলাম। অল্পকিছু লোক। কিন্তু গতকালের দমবন্ধ অবস্থা নেই। মানুষের চেহারা মানুষকে স্বান্তনা দেয়, স্বস্তি দেয়। সবাই দ্রুত হাঁটছে। বাজার নিয়ে ছুটছে। রিকশা, ভ্যান, সাইকেল, মোটরসাইকেল- খুব কম। ‘ডিম কত নিলো?’ ‘পঁচিশ টাকা হালি’- ভদ্রলোক ছুটতে ছুটতেই বললেন।
পথে দুইবার পুলিশ আমাদের রিজার্ভ সিএনজি আটকালো। গুরুত্বপূর্ণ অগুরুত্বপূর্ণ সব মোড়েই পুলিশি পাহারা বসেছে। এ লড়াইয়ে তাদের অস্ত্র বন্দুক নয়; মাইক। কয়েক জায়গায় কিছু লোকদের দেখলাম চ্যালাকাঠ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। রিকশার পাম্প ছেড়ে দিচ্ছে, গুলির মতো গালি বর্ষণ করছে, সিএনজি-রিকশা-অটোরিকশা কোথায় যাচ্ছে কেন যাচ্ছে জিজ্ঞেস করছে। উত্তরে সন্তুষ্টি না হলে ফেরত পাঠাচ্ছে। বাইকে একজনের বেশি দুইজন এলাউ করছে না।
শহর লক ডাউন মানে শহরে ঢোকার সব প্রবেশপথ বন্ধ। মহাসড়কে এক-দুই পণ্যবাহী ট্রাক ছাড়া কিছু নেই। আর এম্বুলেন্স। রাস্তা এখন লাল সাদা এম্বুলেন্স গাড়ির দখলে। কখনো সাইরেন বাজিয়ে, কখনো সাইরেন ছাড়া। মাঝেমাঝে জলপাইরঙা আর্মি জীপ, আর্মি ট্রাক। রাস্তার ধারে সবগুলো প্রবেশপথ বন্ধ। কোথায় বাঁশ দিয়ে, কোথাও শক্ত করে দড়ি বেধে। যতটুকু ফাঁক একটি সাইকেল ঢোকানোও কষ্ট হবে।
রাস্তার দু-ধারে ধানগাছ গুলো বড় হয়ে গেছে। চুলে পাক ধরার মতো মাথার দিকটায় একটু সোনালি। এ বিশাল ধানক্ষেতে একজন লোক মাত্র আগাছা বাছছেন। রৌদ্র তার উদোম কালপিঠ ঘামে চকচক করছে। লকডাউন বাড়লে এ বছর ধানের কি হবে- কেউ জানে না!
রাস্তা এতোটাই ফাঁকা- এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত দেখা যায়। বাসস্ট্যান্ডে সারি করে দাঁড়ানো গাড়ির বহর। দেখলাম এক ছিন্নমূল পরিবার যাত্রী ছাউনিতে বসে আছে। মুড়ি চিবোচ্ছে। মুড়ি এমন এক খাদ্য যে আপনাকে ইল্যুশন দিবে, আপনি মাড়ির নিচে অনেক কিছু চিবোচ্ছেন! অনেকক্ষণ চিবোচ্ছেন!
হাসপাতাল বরাবরের মতো ফাঁকা। সরকার নির্ধারিত দশটি স্যাম্পল পাঠাতে গিয়ে স্টাফদের ঘাম ছুটে যাচ্ছে। কেউ মারা গেলে বারবার খোঁজ নেয়া হচ্ছে করোনার কোনো লক্ষণ ছিল কিনা। পিপিই পরে বসে আছেন হাসপাতালের সবাই। ডাক্তার, নার্স, টিকিট বিক্রেতা, এমএলএসএস, স্যুইপার- প্রায় সবাই। আতঙ্কের জোরেই হাসপাতাল নীরব হয়ে আছে। কোভিড মেড অল কোয়েট অন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট!
তারপরও মানুষ ছুটছে। এক জেলা থেকে আরেক জেলা। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম। রিকশা, অটোরিকশা, ভ্যান, এম্বুলেন্স, মোটরসাইকেল, সিএনজি, গাড়ি, পায়ে হেঁটে। প্রয়োজন আইন মানে না। এক ভদ্রলোক ময়মনসিংহ থেকে সিরাজগঞ্জ চলেছেন ভেঙ্গে ভেঙ্গে। প্রত্যেক গন্তব্যে পৌছানোর গল্পই অনেক ইনস্পায়ারিং!
আমিও কিভাবে কিভাবে গেলাম আবার ফিরে আসলাম। আরেকটি দিনের শেষ। ৮/০৪/২০২০।