২৮ এপ্রিল ২০২০, মঙ্গলবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
আজ সকালে যেতে যেতে দেখলাম রাস্তায় অনেক লোক। কেউ মহাসড়কের দুইপাশে ট্রান্সপোর্টের জন্য দাঁড়িয়ে আছে, কেউ হাঁটছে। সিএনজি, অটোরিকশা, পিকআপ ভ্যান, মোটরসাইকেল- রাস্তায় গাড়ির সংখ্যাও অনেক বেশি। বাস ছাড়া প্রায় সব ধরনের যানবাহন আছে। তবে মানুষের সাপেক্ষে যথেষ্ট নয়। গার্মেন্টস খুলে দেয়ায় সারাদেশ থেকে লোকজন কর্মস্থলে যাচ্ছে। ভীড় নিয়ন্ত্রণে পুরো রাস্তায় কোনো পুলিশ দেখি নি।
সম্ভবত একটি বিশ্বাস সবার মধ্যে ছিল যে গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে। মানুষ মেনেও নিয়েছে যেন আর কতদিন লকডাউন? আর কতদিন কর্মহীন হয়ে বসে থাকা? তবে করোনার প্রকোপ এখনো কমে নি। আবার যে খুব বেড়ে গেছে- তাও নয়। দেশের নীতি নির্ধারকরা ‘হার্ড ইমিউনিটি’র লাইনে যেতে চাচ্ছেন কিনা বোঝা যাচ্ছে না। দেশে ইয়ং পিপলের সংখ্যা বেশি। এরকম কোনো দুরভিসন্ধি থাকতে পারে। যদি এমন হয় তা ঈশ্বরের নাম নিয়ে পানিতে ঝাপ দেয়ার মতো হবে। সাঁতার না জানলেই সবসময় পানিতে ডুবে মৃত্যু হয় না- এটি ধ্রুব সত্য।
অনেকে বলছেন পরীক্ষার অভাবে দেশে করোনা রোগী কম। এরকম চিন্তাধারার লোকই বেশি। অন্যপক্ষ যুক্তি দিচ্ছেন যদি তাই হতো আক্রান্ত কম দেখালেও মৃত্যু তো থেমে থাকতো না। সমন্বয়হীনতা, অবিশ্বাস, তথ্য লুকানো- কোনো মতবাদকেই স্থির ভিত্তিতে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। অনেকে পরীক্ষা করতে আগ্রহী- সুযোগ পাচ্ছেন না। আবার অনেক জায়গায় স্যাম্পল কালেক্ট করার জন্য রোগী পাওয়া যাচ্ছে না। সামাজিকভাবে হেয় হবার ভয়ে লোকজন পরীক্ষা করতে চান না। অধিকাংশের ধারনা- চোখ বন্ধ রেখে প্রলয় ফেস করা ভাল! এবং এ ধারনা একেবারে অমূলক নয়। অনেক রোগী আসেন যাকে এলাকাবাসী জোর করে পাঠায় কেবল অন্য ডিস্ট্রিক্ট থেকে ফেরার জন্য।
গণস্বাস্থ্যের তৈরি কিট নিয়েও ধোঁয়াশা আছে। এটি দিয়ে টেস্ট করলে ক্ষতি কী হতো- কেউই উত্তর পাচ্ছেন না। এখানে আরেকটি জিনিস স্পষ্ট। আমাদের কোনো লেভেলে কোনো সংস্থা নেই- যাকে আমরা বিশ্বাস করতে পারি। দীর্ঘদিন ধরে মেধা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন না হওয়ায় আমরা এখন প্রায় কিছুই বিশ্বাস করি না। এমনকি নিজেদেরকেও না। নিজেকেও না। বাস্তবতা হচ্ছে- এখন আমার ব্যাচে সবচেয়ে ভাল পজিশনে যে সে ঠিক কোনো মাপকাঠিতেই বেস্ট নয়।
আজ হাসপাতালে ঢোকার সময় এক ‘ব্রট ডেড’ দেখলাম। বাইক একসিডেন্ট এ স্পট ডেড হয়েছে। তার স্বজনরা কান্নাকাটি করছিল, ছেলেটার বাবা অসহায়ের মতো আমাদের বিছানায় শুয়ে ছিল। কী করবেন- বুঝে পাচ্ছিলেন না। একটু দূরেই করিডোরে ট্রলির উপর তার ছেলে শুয়ে আছে। হয়তো একটু আগেই সকালের খাবার খেয়ে বের হয়েছিল, হয়তো গত রাতেই সামান্য বিষয় নিয়ে তাদের কথা কাটাকাটি হয়েছিল, হয়তো সংসার নিয়ে বাপ ব্যাটার মাঝে কোনো গোপন চুক্তি ছিল- সে চুক্তির কী হবে তা নিয়েই ভাবছিলেন।
মনে পড়ে একজন রোগী ভর্তি ছিল- শুধু জিজ্ঞেস করতো ‘ক’টা বাজে’। কত তারিখ বা কি বার না, শুধু ‘ক’টা বাজে’। আমরা অবাক হতাম। সিসিইউ-তে ভর্তি রোগী, সকাল বিকালের বালাই নেই, দুই তিন দিন পার হয়ে গেছে- ক’টা বাজে দিয়ে কি করবে! কখনো কখনো বিরক্ত নিয়ে বলতাম- ‘বাবা ক’টা বাজলো জেনে কী করবেন? ঘুমান।’ রোগীটা মারা গেল। সেদিন একবারও জিজ্ঞেস করলো না ‘ক’টা বাজে’। তিনি কী ঘড়ির কাঁটার কোনো ’একটি’ পজিশন খুঁজছিলেন- কে জানে?
এ পৃথিবীতে অনেকগুলো অদৃশ্য দরজা আছে। কখনো কখনো মানুষ সেটি ওপেন করে ফেলে। এর ভেতর হারিয়ে যায়। সে হতে পারে মহাসড়কে, সিঁড়িতে, লিফটে, বা বাজারে। টাইম, প্লেস, পার্সোন- একে অপরের জন্য অপেক্ষা করে। তারপর আমরা আমাদের মতো ব্যাখ্যা করি। আরটিএ, স্ট্রোক, হার্ট এটাক, কোভিড- ১৯। আজকে ছেলেটা হারিয়ে গেল মহাসড়কে, লোকটা সিঁড়িতে। আমি দু’জনকেই দেখেছি, কিন্তু তারা তখন সেখানে ছিল না।