১৮ এপ্রিল ২০২০
ডা. শুভদীপ চন্দ
দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি দ্রুত টার্ন নিচ্ছে। সন্ধ্যার পর জানলাম পুরো দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ভোর ৬ টা কেউ ঘরের বাইরে যেতে পারবেন না। এদিকে গার্মেন্টস সেক্টর উত্তপ্ত। আসলে কী প্ল্যান কারো কাছে পরিস্কার নয়। শ্রমিকরা বেতনের দাবিতে আন্দোলন করছেন। কিছু গার্মেন্টস খুলে দেয়া হচ্ছে।
ডাক্তার ও মেডিকেল স্টাফরা- বিভিন্ন জায়গায় হেনস্থার স্বীকার হচ্ছেন। বাড়িওয়ালা, প্রতিবেশীরা তাদের থাকতে দিচ্ছেন না। পিপিই বাড়ির ছাদে কেন মেলে দেয়- এ নিয়ে কটুবাক্য শুনেছেন আমাদের এক নার্স। আমার এক বাড়িওয়ালা আমার সাথে অচ্ছুতের মতো আচরণ করছেন। আমাকে চাবি দেন দূর থেকে, আবার আমার হাত থেকে নেন না। আমি রেখে দিই, তারপর নেন। সত্যিই ‘দ্যায়ার আর মোর থিংস ইন হ্যাভেন এন্ড আর্থ….’।
তবে সবচেয়ে বড় কথা ডাক্তাররা মুখ খোলা শুরু করেছেন। অভাব অভিযোগের কথা প্রকাশ্যে বলছেন। এটি আমাদের দেশে খুবই বিরল। আমি যতটুকু দেখেছি- আমাদের প্রথম পিপিই দিয়েছিল চারটি। এগুলো ওয়ান টাইম ইউজের জন্য। ধোয়ার পরপরই ছিড়ে যায়। পরে কিছু এসেছে, সেগুলো আমরা এখনো খুলি নি। চশমা- খেলনার চশমার মতো। আমার চশমার উপর দিয়ে এ চশমা আমার কানে আটকে না। N95 মাস্ক সাতটি এসেছে। এটি আদৌ N95 কিনা আমরা নিশ্চিত নই। অথচ লিস্ট এ দেখলাম আমাদের ১৭৫ টি N95 দেওয়া হয়েছে! এটি নির্জলা মিথ্যে। আমাদের একটি করে কাপড়ের মাস্ক দেওয়া হয়েছিল। উপজেলা থেকে লোকালি চেষ্টা করে রেনকোটের কাপড়ে বানানো পিপিই আমরা পরি। প্রতিদিন ধুয়ে দেই।
আমাদের যারা স্যাম্পল কালেকশন করেন ল্যাব টেকনেশিয়ান- তারা দুই লেয়ারের কাপড়ের মাস্কটি পরেন। বা সার্জিক্যাল মাস্ক। সার্জিক্যাল মাস্ক প্রতিদিন ধুতে থাকলে ছিড়ে যায়। সাধারণত গ্লাভস বদলান না। কারন গ্লাভসের সাপ্লাই একদমই নেই। আমরা আপাতত খালি হাতেই রোগী দেখছি, অথবা ব্যক্তিগত ভাবে কিনে নিচ্ছি। কেউ কেউ ওয়ান টাইম গ্লাভস ধুয়ে ধুয়ে চালাচ্ছেন!
প্রতিদিন নতুন নতুন আক্রান্তের কথা শুনছি। পরিচিত এক দুইজন এর মধ্যে থাকছেন। এ খবরগুলোতেও আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। কিছুদিন পর হয়তো মৃত্যুর খবরেও স্বাভাবিক থাকব! আমরা যারা আক্রান্ত হই নি- সেটি পোশাকের জন্য নয়। রোগী পাই নি সেজন্য। এভাবে খুব বেশিদিন বেঁচে থাকা সম্ভব বলে মনে হয় না। আজ শুনলাম গতকাল যে তালিকা দেওয়া হয়েছিল স্বাস্থ্যকর্মীরা অমুক অমুক হোটেলে থাকবেন, সেগুলো তাদের দেওয়া হচ্ছে না। থাকছেন সরকারি বিল্ডিংয়ে।
এর মাঝে বদলি চলছে। একটি আতঙ্ক সর্বত্রই। কেউ কেউ মাসের পর মাস বেতন পাচ্ছেন না। বলছে ‘বাজেট ঘাটতি’। আমি নববর্ষের বোনাস এখনো পাই নি। আমার মতো অনেকেই আছেন। বেসরকারি পর্যায়ে অবস্থা সম্ভবত আরো খারাপ।
এ শহরটি লকডাউন। আজ এগারো দিন ধরে। সকালের দিকে রাস্তায় লোকজন বেশি থাকে। দুপুরের দিকে একদম কমে যায়। মিষ্টির জন্য বিখ্যাত এ শহর- সব মিষ্টির দোকান বন্ধ প্রায় একমাস। এটিই প্রথম নববর্ষ দেখলাম যে লোকে মিষ্টি খায় নি। চায়ের দোকানে সবাই গোল হয়ে বসে চা খাচ্ছে- এটি এখন সবচেয়ে দুর্লভ দৃশ্য। টি-স্টল গুলো একটি শহরের প্রাণ, শহরের প্রধান পার্লামেন্ট। কতটা অসহায় হয়ে শহর এগুলো ছাড়া থাকছে- ভাবতেই খারাপ লাগে।
গোপনে বড় ধরনের ম্যাসাকার হবে সে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। পঞ্চাশটি বেড উপজেলায় আরো রেডি করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী আমাদের কাছে প্রয়োজনীয় জিনিসের তালিকা চেয়েছে। আমরা যতদূর মনে আসে সংখ্যা সহ তালিকা বানিয়েছি। আসলে এটি আমাদের জন্য টাফ কাজ। তবে সেনাবাহিনীকে জড়িত করা খুব ভাল সিদ্ধান্ত। দ্রুত হাসপাতাল লাইক স্ট্রাকচার বানাতে গেলে সেনাবাহিনী ছাড়া সম্ভব নয়। তবে এখন করোনা পজিটিভ রোগী ছাড়াই আমাদের যে অবস্থা, রোগী ভর্তি হওয়া শুরু হলে আমরা কি ল্যাজেগোবরে করবো- সে নিয়ে ভাবছি। অতো ম্যান পাওয়ারও নেই। পজেটিভ রোগী আসলে এক সেট কোয়ারেন্টাইন এ চলে যাবে। এখানে ডাক্তার সিস্টার কারো আক্রান্ত হওয়া মানে শুধু একজন ফাইটার কমে যাওয়া নয়, সাথে একজন রোগীও বেড়ে যাওয়া।
মানে এটি সর্বোচ্চ খারাপ অবস্থা নয়। সামনে আরো খারাপ দিন দেখতে যাচ্ছি। সে পর্যন্ত বেঁচে থাকতে হবে।
এদিকে সজনে গাছ গুলো নুয়ে পড়ছে সজনে ডাটায়। অল্প কিছু ছোট ছোট পাতা। পাতা সব ফুলে ঢেকে আছে। এরকম একটি অপুষ্ট চিকন গাছ কিভাবে এতগুলো লাঠির মতো বড় বড় সজনে ধরে- সে রহস্যই আমার কাটে না। আরেক রহস্যময় গাছ মনেহয় তরমুজ। এখন বাজারে প্রচুর তরমুজ। ফলের দোকান লকডাউনে খোলা থাকে বলেই দেখা যায়। তরমুজের স্তুপ করে পিছনে বিরস বদনে বিক্রেতা বসে থাকেন। এমনিই ক্রেতা নেই, যা আসেন দাম শুনে চলে যান। তরমুজের যে আকৃতি আর যা রস আমার ধারনা ছিল এটি বেল, আম, তেঁতুল বা কাঁঠাল গাছের মতো শক্ত সামর্থ্য গাছ হবে। নদীর ধারে লতানো নুয়ে পড়া দুর্বল তরমুজ গাছ- আমি যেদিন প্রথম দেখি বিশ্বাস করতে পারি নি। তরমুজের রঙ নিয়েও আমার দ্বিধা কাটে না। সবুজ, টিয়া, কালো, ডোরাকাটা- কোনটি আসল? অবশ্য সবগুলোতেই কিভাবে যেন মানিয়ে যায়! ভেতরটা রাঙা হলেই হলো।