লাইফ ইন লকডাউন, ডে টেন

১৭ এপ্রিল ২০২০
ডা. শুভদীপ চন্দ

ফ্রম রুফটপ টু গ্রাউন্ড ফ্লোরঃ এ রিভিলেশন

আগে স্কয়ার হাসপাতালে চাকরি করতাম যেখানে দিনে পঞ্চাশ হাজার টাকা মানুষ অনায়েসে খরচ করে ফেলতো। এখন সরকারি হাসপাতালে এমনও রোগী দেখি যে পাঁচ টাকা খরচ করতে অপারগ। একি পৃথিবী, একি দেশ, একি রোগ- অথচ কত বৈষম্য।

অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক প্রেক্ষিত বাদ দিলে সব বৈষম্যের ভিতর এক অন্য সুর আছে। ধরুন, কোনো এক ক্লাসে একশো জন ছাত্র আছে। আপনি সবাইকে নিয়ে কক্সবাজার সী বিচে গেলেন। বললেন- সবাইকে সমুদ্র থেকে পানি তুলে সৈকতে ফেলতে হবে। সময় এক ঘন্টা। কেউ হয়তো এক আঁজলা পানি তুলে ফেলবে, কেউ এক ছিপি, কেউ এক মগ, কেউ এক বালতি, কেউ এক ড্রাম, কেউ বা এক দুই ছিটায় যত পানি উঠে ততটুকু।

দেখলেন তো কত পার্থক্য হয়ে গেল! সমুদ্র কিন্তু বৈষম্য করছে না। বৈষম্য করছে মানুষের চিন্তা, তাদের ধ্যান ধারণা। তাদের চালিকা শক্তি। যে ছেলেটা এক আঁজলা পানি তুললো তার সময়ের অভাব ছিল না, চাইলে আরো এক হাজার আঁজলা পানি তুলতে পারতো। কিন্তু সে তুলে নি। কারন সে প্রয়োজন মনে করে নি। প্রকৃতি কাউকে কম বেশি করছে না। সে শুধু রিড করছে। মাইন্ড রিড করছে- কে কি চাচ্ছে। তাকে তাই দিচ্ছে।

স্কয়ার হাসপাতালের রোগীরা সুস্থতা চায়, আমার হেলথ কমপ্লেক্সের এখনকার রোগীরা চায় গতকাল যতটুকু ছিল ততটুকু নিয়েই বাকি জীবন যাপন করতে। বিশ টাকা বিড়ির খরচ তাদের গতকাল ছিল, আজও আছে- দশটাকার ঔষধের খরচ তাদের নেই। এটা বারডেন। গতকালের অসুখটা বারডেন নয়।

হুমায়ুন আহমেদ এক নাটকে দেখেছিলাম সম্ভবত। এক রিকশাচালককে একজন জিজ্ঞেস করছে- পৃথিবী যদি কাল ধ্বংস হয়ে যাবে তুমি জানো, তুমি কি করবে? সে বলেছিল- ‘আমি বউকে নিয়ে সারাদিন রিকশায় ঘুরবো। মাঝেমধ্যে বলবো- ওই মিয়া একটু জোরে টানো, দশটাকা বেশি দিমু নি…!’ আমি দৃশ্যটি দেখার পর থেকে ভাবি- সে যদি এমন পৃথিবী ধ্বংসের আগাম খবর পায়, যেকোনো কিছু করার অপশন পায়, সে কেন বললো না- আমি বউকে নিয়ে গাড়িতে ঘুরবো, উড়োজাহাজে ঘুরবো, মাঝ সমুদ্রে সাত পাল তোলা জাহাজে ঘুরবো। কারন তার সে আকাঙ্ক্ষাটি নেই। সে রিকশা চালানোর চেয়ে আর বেশি উপরে উঠবে কি করে!

ভাগ্য, সৌভাগ্য, দুর্ভাগ্য- এগুলো অনেক পরে সৃষ্টি। আসলে অধিকাংশের সে স্বপ্নটিই নেই। স্বপ্ন থাকলে সেখানে জোর নেই। শুধু রোগী না, আমার কলিগদের মধ্যেও পার্থক্য দেখি। স্কয়ারের অধিকাংশ কলিগের প্রাইভেট গাড়ি ছিল, আইফোন ছিল, অভিজাত এলাকায় নিজস্ব বাড়ি ছিল। তারা যখন খাওয়ার কথা বলতো ক্ষুধার জন্য বলতো না। ”শুনেছি- এ দোকানের স্বাদ অন্যরকম, স্বাদ ভাল”- এটা খেতে হবে। দামের চেয়ে স্বাদ জরুরি। এখনকার কলিগদের মধ্যে দেখি- আগে প্রয়োজন মেটানো, ক্ষুধা নিবৃত্ত করো। স্বাদ ভাল হলে সেটা বাড়তি পাওনা।

আমি কোনো দুঃখবোধ বা তুলনা থেকে এ লিখছি না। সবাইকে সমান করে এ কাতারে আনতেও চাচ্ছি না। আমি বলতে চাচ্ছি আসলে সবার জন্যই সমান সুযোগ আছে। কিন্তু সবার ভিতরে সে সমান আকর্ষণটি নেই। মানুষের একেকজন একেক খেয়াল। আর সে খেয়াল অনুসারে মহাজগৎ তাকে সেটি পাইয়ে দিচ্ছে।

সর্বশেষ দশ বছর আগের এক ঘটনা বলে শেষ করবো। আমার রুমমেট ছিল নেপালী। একদিন কথা প্রসঙ্গে সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো- কি প্ল্যান বিশ বছর পরের? আমি বলেছিলাম- বিসিএস করবো, বিকেলে পাঁচ-দশটা রোগী দেখবো, টং ঘরে বসে চা খাবো। তোমার কি প্ল্যান? সে বললো- ‘ইউরোপ বা আমেরিকায় স্যাটেল হবো’। আজ সে জার্মানির ডাক্তার। দেখেন- ঠিকই আছে। আমাদের লক্ষ্য তো এমনি ছিল! আমি ওখান থেকে এর চেয়ে বেশি দেখতে পারি নি, সে ইউরোপ আমেরিকা দেখেছিল। পৃথিবী কাউকে নিরাশ করে নি।

তাই ভাল তুলনা না করা। তাই ভাল অন্যের সাফল্যে হিংসাত্মক না হওয়া। অহেতুক ভাগ্যের উপর দোষারোপ না করা। তার প্রাপ্য সেটা কারন সে সেটা স্বপ্ন দেখার সাহস করেছে। তারা ভেবেছে তাদের জীবনের জন্য স্কয়ারের পঞ্চাশ হাজারের চিকিৎসা লাগবে। আপনারা ভেবেছেন সরকারি ফ্রি ঔষধই যথেষ্ট। দুটোই জীবন।

মধ্যবিত্ত বা গরিব হওয়ার পিছনে ষড়যন্ত্র নেই। ধনী হওয়ার ডিজেয়ারের অনুপস্থিতি আছে। আপনি হয়তো অন্যকোন দিক থেকে ধনী। ভাবে, মহত্ত্বে, অবসরে, কথায় বা চিন্তায়। সে ডিজেয়ার আপনার ছিল। আপনি পেয়েছেন।

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

সুস্থ হলেন ডেলটা মেডিকেলের আইসিইউ প্রধান ডা. রিফাত হোসেইন মালিক

Fri Apr 17 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ শুক্রবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২০ ডেলটা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এর ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের (আইসিইউ) প্রধান ডা. রিফাত হোসেইন মালিক কোভিড-১৯ থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছেন। তিনি ২৬ মার্চ হতে আজ সকাল পর্যন্ত কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিলেন। উল্লেখ্য, গত ২৬ মার্চ তিনি কোভিড-১৯ পজেটিভ শনাক্ত হোন। ডেলটা মেডিকেল […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo